বান্ধব নাট্য সমাজের প্রেক্ষাগৃহের হাল এখন এমনই। রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
তখন এক উত্তাল সময়। ইংরেজকে ভারত ছাড়ার ডাক দিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলনের রেশ আছড়ে পড়ছে সাংস্কৃতিক জগতেও। স্বদেশপ্রেমের একের পর এক নাটক তোলপাড় করে দিয়েছে মঞ্চ। সে সময়ে জলপাইগুড়ির বান্ধব নাট্য সমাজের মঞ্চে হাজির শিশিরকুমার ভাদুড়ি। অনুষ্ঠানের শেষে বান্ধব নাট্যের এক সদস্যকে ডেকে বলেছিলেন, “এই হলটা খুব ভাল। যত্নে রাখবেন।”
তার পরে করলা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে, নদীই এখন নাব্যতার সঙ্কটে। একই রকম সঙ্কটে বান্ধব নাট্য সমাজও। প্রেক্ষাগৃহের ছাদ ঝুলে মাটির দিকে নেমে এসেছে, বসার চেয়ারগুলি ভাঙাচোরা। যে কোনও মুহূর্তে বড় মাপের দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই চলছে প্রেক্ষাগৃহটি। মহলা হলটিরও অবস্থা শোচনীয়। গাছের শেকড় ফুঁড়ে দিয়েছে সাজঘরের দেওয়াল। অযত্নে নষ্ট হয়ে গিয়েছে ঝুলতে থাকা বড় আলো। মেঝে ফুঁড়ে মাথা তুলেছে আগাছা।
শুধু বান্ধবনাট্য সমাজই নয়, জলপাইগুড়ি শহরের সংস্কৃতিপ্রেমীদের আক্ষেপ, উত্তরবঙ্গে ‘সংস্কৃতির শহর’ বলে পরিচিত জলপাইগুড়ির প্রেক্ষাগৃহগুলির অবস্থা কমবেশি একই রকম।
করলা নদীর পাশেই একসময়ে গড়ে উঠেছিল আইটিপিএ তথা চা বাগান মালিকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের অফিস। সে সময়ে বিভিন্ন চা বাগানের কর্তা-ব্যাক্তিরা জলপাইগুড়ি তথা উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। আইটিপিএ অফিসেই তৈরি করা হয়েছিল একটি প্রেক্ষাগৃহ। যেটি আইটিপিএ মঞ্চ নামে পরিচিত। এখন আর সেই হলটি নেই। এক দশক আগে সে হলটি সংস্কার করে তৈরি হয়েছে, চা নিলাম কেন্দ্র। হারিয়ে গিয়েছে টাউন হলও। স্বাধীনতার আগে এবং পরে টাউন ছিল শহরের যে কোনও সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক কর্মসূচিরও অন্যতম উৎসস্থল। শতাব্দী প্রাচীন সেই টাউন হল সময়ের সঙ্গেই অবহেলা আর অনাদরে ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ। এখন সেই হলে জলপাইগুড়ি পুরসভার জনস্বাস্থ্য বিভাগের অফিস। টাউন হলে অনুষ্ঠানের স্মৃতি জলপাইগুড়ি শহরের কিছু প্রবীণ বাসিন্দার স্মৃতিতেই রয়ে গিয়েছে।
প্রবীণদের স্মৃতিতেই আটকে রয়েছে রাতভর ফিটন গাড়ির লাইনের সেই ছবিও। রাতভর নাটক চলছে আর্যনাট্য সমাজের প্রেক্ষাগৃহে। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে শহরের তৎকালীন প্রভাবশালীদের ব্যক্তিত্বদের ফিটন গাড়ি। এই আর্যনাট্য সমাজের মঞ্চ থেকেই বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্লোগান শুনেছিলেন শহরের তৎকালীন বাসিন্দারা। সকাল বেলায় রাজবাড়ির পুকুরে ডুব দিতেন সমাজের সদস্যরা। মঞ্চে এসে তাঁরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্লোগান দিয়েছেন, নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। দেশভাগ-সহ নানা রাজনৈতিক উত্থানপতনের সাক্ষী এই প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চের কাঠে এখন ঘুণ ধরেছে। কাঠের পাটাতন ভেঙে গিয়ে মঞ্চের হাল এখন বিপজ্জনক। দর্শকদের বসার প্লাস্টিকের চেয়ারগুলির বেশিরভাগই ভেঙে পড়েছে। দেওয়াল ফাটিয়েছে গাছের শেকড়। ১৯০৪ সালে রেজিস্ট্রেশন হওয়া আর্যনাট্য সমাজ এখন রবীন্দ্রভবন নামে পরিচিত।
বছর খানেক আগেও বর্ষার সময়ে রবীন্দ্রভবনে অনুষ্ঠান করতে ভয় পেতেন উদ্যেক্তারা। বৃষ্টি হলেই মঞ্চের সামনে জল থইথই। চেয়ারে হাঁটু মুড়ে বসতে হতো সামনের বেশ কয়েকটি সারির দর্শকদের। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে ভবন সংস্কারে প্রায় ১ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে সেই কাজও শুরু হয়। এক বছর ধরে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রেখে কাজ করার পরে গত অক্টোবর মাসে উদ্যোক্তাদের হাতে ফের মঞ্চের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ, জল জমার সমস্যা এবং সাউন্ড সিস্টেমের কিছু কাজ ছাড়া কোনও সংস্কারই হয়নি। খোঁজ নিয়ে উদ্যোক্তারা জানতে পারেন এখনও ৭৮ লক্ষ টাকার কাজ বাকি রয়েছে। সে কাজ কবে শুরু হবে জানেন না উদ্যোক্তারা। তাঁদের আক্ষেপ, “একসময়ে বিভিন্ন মহলে দরবার করেও বরাদ্দ মেলেনি, এখন সংস্কার কাজ শুরু হলেও মাঝপথে থমকে গিয়েছে।” অর্ধেক সংস্কারে মঞ্চে শব্দ সংযোজনের ব্যবস্থাও করা হয়নি বলে অভিযোগ। খোলা বিদ্যুতের প্যানেল বোর্ড আর পাটাতন ভাঙা মঞ্চে যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়েই সংস্কৃতির টানে এখন রবীন্দ্রভবনে আসছেন শিল্পী-দর্শকরা।
বিস্তর লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই জলপাইগুড়ির কলাকেন্দ্র তথা আর্ট গ্যালারি বেসরকারি হাতে দেওয়ার ব্যাপারে মত দিয়েছিলেন জলপাইগুড়িবাসী। সেই হলের বসার আসনও ভাঙতে শুরু করেছে। শৌচাগারে গেলেই নাকে উৎকট গন্ধ আসে। বাতানুকূল যন্ত্রটিও বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ থাকছে বলে অভিযোগ। যদিও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বাতানুকূল যন্ত্র সংস্কারের কাজ চলছে।
কোনও প্রেক্ষাগৃহের হাল-ই একদিনে বেহাল হয়ে যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে এমন চললেও, কিন্তু কোনও হলেই থেমে থাকেনি সংস্কৃতির চর্চা। তবে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে। কখনও সখনও সে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও হয়েছে। কিন্তু স্থায়ী সমাধান মিলবে কোন পথে? কী বলছেন সংস্কৃতিপ্রেমীরা? প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরাই বা এ নিয়ে কী ভাবছেন?
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy