Advertisement
১৭ মে ২০২৪

আঁকই ভরসা, মন ফেরত জিলিপি আর ফুটবলে

রাত জেগে ইউরোপের ফুটবল দেখা বন্ধই করে দিয়েছিলেন মহেন্দ্র রায়। মনোহর তিরকে প্রায় বিদায় জানিয়ে ফেলেছিলেন প্রিয় মিষ্টি, জিলিপিকে। ভোটের বাদ্যি বাজতেই সব ছেড়েছুড়ে, অমানুষিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন দু’জনে। কিন্তু লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রের দুই বাম প্রার্থী ফের মজেছেন পুরনো অভ্যাসে। রহস্যটা কী? ‘অনেকটা চাপ-মুক্তি’, খবর বাম-অন্দরের।

কিশোর সাহা ও অনির্বাণ রায়
জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৪ ০৪:৩৪
Share: Save:

রাত জেগে ইউরোপের ফুটবল দেখা বন্ধই করে দিয়েছিলেন মহেন্দ্র রায়। মনোহর তিরকে প্রায় বিদায় জানিয়ে ফেলেছিলেন প্রিয় মিষ্টি, জিলিপিকে। ভোটের বাদ্যি বাজতেই সব ছেড়েছুড়ে, অমানুষিক দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন দু’জনে। কিন্তু লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রের দুই বাম প্রার্থী ফের মজেছেন পুরনো অভ্যাসে। রহস্যটা কী? ‘অনেকটা চাপ-মুক্তি’, খবর বাম-অন্দরের।

ইতিহাস এবং পরিসংখ্যান সাক্ষী, উত্তরবঙ্গের এই দুই লোকসভা আসনই ছিল বাম-দুর্গ। দুই কেন্দ্রেরই অনেকটা জুড়ে রয়েছে চা-বলয়, যেখানকার বাসিন্দাদের ভোট নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ায় সার্বিক ফলে। ২০০৯-এ সিপিএমের মহেন্দ্র রায় জলপাইগুড়ি আসনে জিতেছিলেন ৮৮ হাজারের কিছু বেশি ভোটে। আলিপুরদুয়ারে আরএসপি-র মনোহর তিরকের জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় ১ লক্ষ ২৩ হাজার।

সে বার জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের অন্তর্গত ছ’টি বিধানসভা আসনের পাঁচটিই ছিল বামেদের দখলে। একটি কংগ্রেসের। কিন্তু তার পরে এলাকার রাজনৈতিক ছবি ক্রমেই পাল্টেছে। ২০০৯-এ রাজগঞ্জ বিধানসভার উপ-নির্বাচনে বামেদের হারিয়ে দেয় তৃণমূল। ২০১১-এ আসন পুনর্বিন্যাসের পরে তৈরি হয় নতুন বিধানসভা কেন্দ্র ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি। আর তার পরেই বিধানসভা ভোটে ওই কেন্দ্র-সহ তিনটি আসন যায় কংগ্রেস (১)-তৃণমূল (২) জোটের হাতে। চারটি পান বামেরা।

২০১৩-র আগে জলপাইগুড়ি লোকসভার অন্তর্গত আটটি পঞ্চায়েত সমিতিই বামেদের ছিল। এখন দু’টি তাদের হাতছাড়া। একটি একার জোরে জিতেছে তৃণমূল। অন্যটি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে জোট করে। জেলা পরিষদেও এই প্রথম বার খাতা খুলেছে তারা। ২০টির মধ্যে ৪টি দখল করে। বাকি ১৬টিই বামেদের হাতে। মোট ৮৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে বামেরা জিতেছে ৪১টি, তৃণমূল ৩৯টি। যদিও দল সূত্রের দাবি, ওই পরিসংখ্যানও মহেন্দ্রবাবুকে রাত জেগে টিভিতে ফুটবল দেখা ছাড়াতে পারেনি।

কিন্তু ছবিটা পাল্টাতে শুরু করল ২০১৩-তেই উপ-নির্বাচনে মালবাজার পুরসভা তৃণমূল দখল করে নেওয়ার পর। আর ২০১৪-র গোড়া থেকে শুরু হয়ে গেল দলবদলের পালা। মেখলিগঞ্জ পুরসভার কাউন্সিলররা তৃণমূলে চলে যাওয়ায় ক্ষমতা হারান বামেরা। দলবদলের সুবাদে মালবাজার, ধূপগুড়িসব জায়গাতেই প্রভাব বাড়তে শুরু করে তৃণমূলের। চাপের উপরে চাপ গত ফেব্রুয়ারিতে ময়নাগুড়ির আরএসপি বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারী তৃণমূলে যোগ দিয়ে উপ-নির্বাচনে দাঁড়ান। দল সূত্রের খবর, তখন থেকেই চেলসির নীল, ম্যান-ইউয়ের লাল ফিকে হতে শুরু করে মহেন্দ্রবাবুর জীবনে।

প্রায় একই কারণে জীবন থেকে জিলিপি মুছে যেতে বসেছিল আলিপুরদুয়ার লোকসভার প্রার্থী মনোহর তিরকের। ২০০৯-এ লোকসভায় সাতটি বিধানসভার মধ্যে শুধু কালচিনিতে মোর্চা সমর্থিত নির্দল এবং তুফানগঞ্জে তৃণমূল এগিয়ে ছিল। গত বিধানসভা ভোটে প্রথম ধাক্কা। তুফানগঞ্জ ও ফালাকাটায় বামেদের হারিয়ে জেতে তৃণমূল। কালচিনিতে মোর্চার সমর্থনে জেতা নির্দল প্রার্থী উইলসন চম্প্রামারি তৃণমূলে যোগ দেন। আলিপুরদুয়ার ও নাগরাকাটায় বামেদের হারিয়ে কংগ্রেস জেতে। আরএসপি জিতেছিল কুমারগ্রাম এবং মাদারিহাটে। কিন্তু কুমারগ্রামের আরএসপি প্রার্থী দশরথ তিরকে পদত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন সদ্য। রাজ্যসভার ভোটের সময়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েই লোকসভার টিকিট পেয়ে দশরথ উৎসাহে ফুটছেন। আড়ালে-আবডালে তাঁর অনুগামীরা বলছেন, “আগে মনোহরদাকে (তিরকে) জেতানোর কলকব্জা দশরথদার হাতেই ছিল। ফলে, মনোহরদা এ বার বেকায়দায়।”

বাম-প্রার্থীর জীবন তিতকুটে করার উপাদান আরও ছিল। আগে আলিপুরদুয়ার লোকসভার ভিতরে জেলা পরিষদের ২৪টির মধ্যে ২২টি আসন বামেদের ছিল। ২০১৩-র ভোটের পরে তা কমে দাঁড়ায় ১৫টিতে। পাঁচটি তৃণমূল, দু’টি কংগ্রেস ও দু’টি অন্যদের। আগে ৯টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে কালচিনি ছাড়া সবই বামেদের ছিল। সেখানে গত ভোটে তৃণমূল পায় ফালাকাটা ও তুফানগঞ্জ। কংগ্রেস কালচিনি নিজেদের দখলেই রাখে। বাকি ছ’টি পান বামেরা।

তা হলে কোন খুশির খবর পেয়ে ডায়াবেটিসের রোগী ফের জিলিপিতে মগ্ন? কালজানি নদীর ধারে অষ্টমী স্নানের মেলায় জিলিপির ঠোঙা হাতে মিটিমিটি হেসে মনোহরবাবুর মন্তব্য, “আরে, জিলিপি না খেলে এলাকার লোক রাগ করত যে! না হয় ফের ইনসুলিন নেব।” অন্য দিকে, চেলসি যে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে উঠেছে, সে খবর পৌঁছেছে মহেন্দ্র রায়ের কাছে। ঘনিষ্ঠ মহলে তা নিয়ে চর্চাও করেছেন বিদায়ী সাংসদ। দলের লোকেরা বলছেন, ‘বল-ভরসা’ পেয়েই দুই সাংসদ ফের খোশমেজাজে।

বাম-শিবিরে কথা বলে ‘বল-ভরসা’র যে ব্যাখ্যা মিলছে, তা আসলে ভোট ভাগাভাগির অঙ্ক। বামেদের হিসেব বলছে, তৃণমূল আর বিজেপি তো বটেই, সঙ্গে কংগ্রেসের (জোসেফ মুন্ডা ও সুখবিলাস বর্মা হাল ছাড়ছেন না) নিজেদের মধ্যে ভোট কাটাকাটির জেরে শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে যাবেন তাঁরা। জলপাইগুড়ির প্রবীণ বাম নেতা-নেত্রী জিতেন দাস, মিনতি সেনদের কথায়, “আমাদের থেকে যে ভোট ধসার ছিল, ইতিমধ্যেই ধসেছে। এখন অন্যদের পালা।” বস্তুত, উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতাও বলেছেন, “এ বারও বোধ হয়, ওই আসন দু’টো হল না!”

কিন্তু হিসেবের সামান্য এ দিক-ও দিক হলেই বামেদের অঙ্ক মিলবে কি না, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে অনেকের। উত্তরবঙ্গ নিয়ে দলনেত্রীর আন্তরিকতার জেরে তৃণমূলের দিকে বা মোদী-হাওয়ার জেরে বিজেপি-র দিকে জনতা ঢলে পড়লে বামেদের থেকেও ভোট খসবে বলে মনে করছেন তাঁরা। তৃণমূলের উত্তরবঙ্গের কোর কমিটির চেয়ারম্যান তথা মন্ত্রী গৌতম দেব যেমন বলেছেন, “বামেদের অঙ্ক মিলবে না। হাতে থাকবে পেন্সিল।”

তৃণমূলের বড় ভরসা আদিবাসী বিকাশ পরিষদ। এক সময় চা-বলয়ে বামেরাই শেষ কথা হলেও গত পাঁচ বছরে পরিষদ সেখানে অন্যতম শক্তি হয়ে উঠেছে। গত লোকসভা ভোট তারা বয়কট করেছিল। কিন্তু গত বিধানসভায় কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের প্রবল হাওয়াতেও মাল আসনে লড়ে ২১ হাজারের বেশি ভোট পান পরিষদের প্রার্থী। এ বার পরিষদ তৃণমূলের শিবিরে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তেজকুমার টোপ্পোর দাবি, এই মুহূর্তে পরিষদ অন্তত ১ লক্ষ ভোট নিয়ন্ত্রণ করে। তার উপরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আদিবাসী উন্নয়ন কাউন্সিল’ করছেন বলে চা-বলয়ে ‘খুশির হাওয়া’ বইছে। সেই সুবাদে ভোট আরও বাড়বে। তৃণমূলের সঙ্গে রয়েছেন আত্মসমর্পণ করা কেএলও জঙ্গিদেরও একাংশ, যাঁদের স্থানীয় প্রভাব যথেষ্ট বলে তৃণমূলের একাংশের দাবি। ফলে, প্রত্যাশায় জলপাইগুড়ির তৃণমূল প্রার্থী বিজয়চন্দ্র বর্মন।

পক্ষান্তরে, চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন এবং লাগাতার কর্মবিরতি করার সুবাদে জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে চা-শ্রমিকদের মধ্যে তাঁদেরও জোর বেড়েছে বলে দাবি গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতৃত্বের। মোর্চা এ বারও বিজেপি-র সঙ্গী এবং বিজেপি-র পালে রয়েছে মোদী-হাওয়া। ধূপগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি, এমনকী, জলপাইগুড়ি শহরে নরেন্দ্র মোদীর ছবি লাগানো হোর্ডিং পড়েছে। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়ির কাছে খাপরাইলে ‘নমো’র সভাতেও জলপাইগুড়ি থেকে গিয়েছিলেন অনেকে। জলপাইগুড়ির বিজেপি প্রার্থী সত্যলাল সরকার, আলিপুরদুয়ারের বিজেপি প্রার্থী বীরেন্দ্র বরা ওরাওঁরা যথেষ্ট উত্তেজিত। তাঁদের দাবি, নতুন ভোটারদের থেকে প্রচারের জন্য ১০ টাকা করে চাঁদা চেয়েছিল বিজেপি। জলপাইগুড়ি জেলা জুড়ে অন্তত তিন হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণী চাঁদা দিয়েছেন। এ ছাড়া, কামতাপুর পিপলস পার্টি, প্রোগ্রেসিভ পিপলস পার্টির মতো স্থানীয় দলও রয়েছে বিজেপি-মোর্চার সঙ্গে।

বামেদের আশা, শেষ পর্যন্ত তৃণমূলেরই ভোট কাটবে বিজেপি। কিন্তু বাম-ভোট কমার সম্ভাবনা কি একেবারেই নেই?

মনোহর তিরকে জিলিপিতে কামড় বসাতে গিয়ে থমকালেন। বললেন, “বলছি তো, লড়াইটা আগের চেয়ে অনেক কঠিন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE