সাংবাদিক বৈঠকে প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) দুর্নীতি মামলায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের ভূমিকাও সন্দেহজনক বলে অভিযোগ করলেন সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য। শুক্রবার দুপুরে শিলিগুড়িতে দলীয় অফিসে সাংবাদিক বৈঠকে ওই অভিযোগ করেছেন। অভিযোগের পক্ষে যুক্তি দিতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর নিযুক্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টকে হাতিয়ার করেছেন অশোকবাবু।
ওই রিপোর্টের অংশবিশেষের প্রলিতিপি সাংবাদিকদের হাতে তুলে দেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী। যেখানে একই সংস্থাকে একই দিনে ৩টি বিপুল অঙ্কের কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি রয়েছে। এমনকী, ওই কাজ টেন্ডার কমিটিতে অনুমোদন হয়নি বলেও রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। সেখানেই কমিটি জানিয়েছে, নিয়ম ভেঙে একই সংস্থাকে ৩টি কাজের বরাত দেওয়ার দায় এসজেডিএ-এর নীতি নির্ধারকরা এড়াতে পারেন না। প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর দাবি, “ওই সময়ে এসজেডিএএর নীতি নির্ধারক কমিটি বলতে চেয়ারম্যান সহ সব সদস্যকেই বোঝায়। সেখানে গৌতমবাবুও সদস্য। ওই ঘটনার পরে চেয়ারম্যানকে অপসারিত করা হয়। ইঞ্জিনিয়র-ঠিকাদার গ্রেফতার হন। কিন্তু, নীতি নির্ধারক কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়নি। তাংদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই গৌতমবাবুর ভূমিকা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী তথা এসজেডিএ চেয়ারম্যান গৌতমবাবু অবশ্য অশোকবাবুর অভিযোগ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী এখন এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান পদেও রয়েছেন। তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আমরা হাইকোর্টে জমা দিয়ে দিয়েছি। কাউকে আড়াল করার বিষয় নেই। এটা নিয়ে অশোকবাবুকে ভাবতে হবে না।” মন্ত্রীর পাল্টা অভিযোগ, “উত্তরায়ণ উপনগরী নিয়ে অশোকবাবুর আমলে ২৪৬ কোটি টাকার গরমিল ধরা পড়ায় আইনি পদক্ষেপের চিন্তাভাবনা হচ্ছে। তাই উনি নানা কথা বলছেন।” দুর্নীতি মামলা যখন হয়েছে তখন সংস্থার চেয়ারম্যান ছিলেন রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য। পরে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে তাঁকে সরানো হয়। এদিন শিলিগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রবাবু বলেন, “অশোকবাবু মামলা প্রভাবিত করতে চাইছেন। তদন্ত হচ্ছে। সেখানে যা হওয়ার তা-ই হবে। তখন দেখা যাবে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই রিপোর্ট অনুসারে, ২০১২ সালের ৫ জুন এসজেডিএ-র প্রকল্প টি পার্ক, ড্রাই পোর্ট এবং ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশনের ‘কোল্ড ওয়ারহাউস’ তৈরির বরাত ই-কোটেশনের মাধ্যমে একটি ঠিকাদার সংস্থাকে দেওয়া হয়। আরও দুটি সংস্থা প্রায় একই দর দিলেও ‘এমএস অ্যান্ড কোম্পানি’কে তিনটি কাজের বরাত দেওয়া হয়। বিষয়টি সংস্থার বোর্ড সদস্য বা নীতি নির্ধারক ব্যক্তিবর্গ এবং টেন্ডার কমিটির দেখা উচিত ছিল বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। যা কোনটাই করা হয়নি বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। পুলিশে তদন্তে ওই ঠিকাদার সংস্থার অন্যতম মালিক সুব্রত দত্ত গ্রেফতারও হন। ওই প্রকল্পে যুক্ত দুই ইঞ্জিনিয়র মৃগাঙ্কমোলি সরকার ও সপ্তর্ষি পালও গ্রেফতার হন। প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর প্রশ্ন, “ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়র ধরা পড়েছেন ভাল কথা। কিন্তু, যাঁদের যোগসাজশে ওই কাজ তাঁরা পেয়েছিলেন সেই নীতি নির্ধারকরা ছাড় পাচ্ছেন কার প্রভাবে সেটা মানুষ জানতে চান। তাই সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছি।”
এই ঘটনায় পুলিশ তদন্তে নেমে শিলিগুড়ি পুরসভার তৃণমূলের প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র রঞ্জন শীলশর্মা, মাটিগাড়া নকশালবাড়ির কংগ্রেস বিধায়ক শঙ্কর মালাকার, রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য সহ অনেককেই জেরা করেছে। এখন রঞ্জনবাবুর বক্তব্য, “যা বলার মন্ত্রী গৌতমবাবু বলবেন।” শঙ্করবাবুও একই সুরে বলেন, “আমি বোর্ড সদস্য থেকে ইস্তপা দিয়েছি। তাই এসজেডিএ নিয়ে কিছু বলব না।”
তৃণমূলের নেত্রী জ্যোৎস্না অগ্রবাল এক সময়ে এসজেডিএ-এর টেন্ডার কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলেন। পরে তিনি ইস্তফা দেন। জ্যোৎস্না দেবী বলেন, “আমি ওই সবের কিছু জানতাম না। বোর্ড মিটিঙের সময় প্রচুর কাজের খতিয়ানের কাগজপত্র দেওয়া হত মাত্র।” তৃণমূল নেতা তথা এসজেডিএ সদস্য নান্টু পাল জানান, আদালতেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে।
এসজেডিএ’র নানা প্রকল্পে প্রায় বহু কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পুলিশ তদন্তে প্রথমেই তিন বাস্তুকার মৃগাঙ্কমৌলি সরকার, সপ্তর্ষি পাল, প্রবীণ কুমারকে গ্রেফতার করে। অভিযুক্ত ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধার অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার ছেলে দেবব্রত ছাড়াও বিভিন্ন ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধার অজয় মৈত্র এবং তাপস বসু, শঙ্কর পাল সহ ১৩ জন গ্রেফতার হন। এর পরে তৎকালীন সংস্থার সিইও তথা মালদহের তদানীন্তন জেলাশাসক গোদালা কিরণ কুমারকে গ্রেফতার করা হয়। এর জেরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কারলিয়াপ্পন জয়রামনকে সরিয়ে দেয় রাজ্য সরকার। তখনই সিবিআি তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে একাধিক আবেদন জমা পড়ে। এ ব্যাপারে ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধার সুব্রতবাবু বলেন, “বিষয়টি এখন আদালতের বিচারধীন। আমি জামিনে আছি। কোনও মন্তব্য করব না।”
এসজেডিএ নিয়ে যাদপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy