Advertisement
০৩ মে ২০২৪

খাবার জোগাড় করাই দায় বন্ধ বাগানে

ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে বাড়ির সামনে কাঁদায় ভরা গলির ধারে দাঁড়িয়ে ১২ বছরের বুলবুলি মুণ্ডা এবং এক বছরের ছোট বোন রাখি মুণ্ডা। সামনে মাচা বাঁধা হচ্ছে। বাবা জিতবাহান মুণ্ডা শুক্রবার বিকেল ৫ টা নাগাদ মারা গিয়েছেন। অপুষ্টিতে ভুগে যক্ষায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। শরীরে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল।

ঘরে ঘরে এমনই ছবি ওই বাগানে। ছবি: সন্দীপ পাল

ঘরে ঘরে এমনই ছবি ওই বাগানে। ছবি: সন্দীপ পাল

সৌমিত্র কুণ্ডু ও বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য
জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৪ ০১:৫৬
Share: Save:

ঝির ঝিরে বৃষ্টিতে বাড়ির সামনে কাঁদায় ভরা গলির ধারে দাঁড়িয়ে ১২ বছরের বুলবুলি মুণ্ডা এবং এক বছরের ছোট বোন রাখি মুণ্ডা। সামনে মাচা বাঁধা হচ্ছে। বাবা জিতবাহান মুণ্ডা শুক্রবার বিকেল ৫ টা নাগাদ মারা গিয়েছেন। অপুষ্টিতে ভুগে যক্ষায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। শরীরে হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিকের চেয়ে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল।

বছর তিনেক আগে মা জাওনি মুণ্ডাও রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন। গত কয়েক মাস ধরে ভাত আর আলু সেদ্ধ। ভাগ্য ভাল থাকলে কচু সিদ্ধ এই খাবার জুটছে তাদের পরিবারের লোকদের কপালে। কোনও দিন এক বেলা খাচ্ছেন। শনিবার বুলবুলির ঠাকুরদা ফাগু মুণ্ডা সে কথাই ঘুরে ফিরে বলছিলেন, যেই যাচ্ছে খোঁজ খবর করতে তাঁদের বাড়িতে। ফাগুবাবুর আরেক ছেলে নন্দ, তাঁর স্ত্রী দিপালী এবং তাঁদের দুই ছেলেমেয়েও রয়েছে। গত ২৬ এপ্রিল রোগে ভুগে মারা গিয়েছে ফাগুবাবুর স্ত্রী মান্তি দেবী। বাগান বন্ধ, কাজ নেই। বাগানে কয়েক মাস ধরে জিআর’র চাল সরবরাহ অনিয়মিত। বাড়ির এতগুলি মানুষের খাবার জোগাড় করাই দায়। নন্দর একটা পানের দোকান রয়েছেন। বন্ধ বাগানে সেখানে বিক্রি নেই।

পাশের বাড়ির বাসিন্দা লীলাবতী ওঁরাও। দিন কয়েক আগে তাঁর সদ্যোজাত সন্তান মারা গিয়েছেন। তাঁর শরীরেও হিমগ্লোবিন মাত্রাতিরিক্ত কম। স্বাস্থ্যকর্মীরা শনিবার তাঁকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করাতে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি, স্বামী লোকা মুণ্ডা, আড়াই বছরের মেয়ে অনুরাধা এবং ৬ বছরের ছেলে অনুরাজ রয়েছে। ঘরে চালের দানা নেই। শনিবার বাড়িতে উনুন জ্বলেনি। বাগানের প্রাথমিক স্কুলে মিড ডে মিল রান্না হয়েছে। লীলাবতীর শাশুড়ি বিরসী দেবী সেখান থেকে চেয়ে এক বাটি খিচুড়ি তাঁর মধ্যে একট ডিম সেদ্ধ বেলা আড়াইটে নাগাদ নিয়ে এলেন। ক’ জনের মুখে সেই খাবার দেবেন তা নিয়েই উদ্বিগ্ন তিনি।

অভাবের তাড়নায় বাড়ির লোহার গ্রিল অবধি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বন্ধ রায়পুর চা বাগানের বাসিন্দারা।

বন্ধ রায়পুর চা বাগানের ভগত লাইন, গুদাম লাইন, লোহার লাইন সর্বত্রই শ্রমিক পরিবারের বাড়িগুলির একই চিত্র। কেউ বাড়ির শিশুদের নিয়ে এক বেলা খেয়ে বেঁচে রয়েছেন। কারও বাড়িতে কোনও দিন অনাহার চলছে। ২২-২৭ জুনের মধ্যে এই বাগানে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টিতে ভুগে। অনিমেষ বরাইক স্ত্রী এবং দুই মেয়েকে নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই এক বেলা আধপেটা করে খেয়ে রয়েছেন। ভাত আর আলু সেদ্ধ।

রাজু ওরাও কাজের খোঁজে দিল্লি চলে যেতে চাইছেন। বাড়িতে স্ত্রী এবং দুই কিশোর ছেলে এক কিশোরী মেয়ে রয়েছে। ৩ মাস ধরে তিনি জিআর-এর চাল পাচ্ছেন না। এ দিন অন্য একটি ছোট বাগানে পাতা তোলার কাজ করে কিছু টাকা পেয়েছেন। সন্ধ্যায় তা দিয়ে চাল নিয়ে এলেন। ভগত লাইনের বাসিন্দা অবিনাশ ওরাও এবং তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী। কোলে ৩ মাসের ছেলে। ছেলের খাবারের প্যাকেটের গুঁড়ো দুধ কেনার টাকা জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছেন। নিজেদের খাবার ভাত আর আলু সেদ্ধ। ভাত বেশি হলে তা পান্তা করে রাখছেন। পরের দিন সকালের খাবার হচ্ছে তা দিয়েই। এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য প্রধান হেমব্রমের দাবি, “বাগানের অধিকাংশ বাড়ি এক বেলা খাচ্ছে। তাও খাবার বলতে ভাত আর আলু সেদ্ধ। জিআর-এ চাল বিলি বন্ধ রয়েছে ১ মাসেরও বেশি। এ ভাবে চলতে পারে না। প্রশাসনকে বলেছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE