দিনেদুপুরে চুরি হয়ে যাচ্ছে ফুটপাত। ফুটপাতের হাতবদল হচ্ছে রাতেও। তাই ফুটপাতে হাঁটার কথা ভাবতে পারে না শিলিগুড়ি। নিরুপায় হয়ে প্রাণ হাতে রাস্তা দিয়েই চলাফেরা করতে হয় শহরবাসীকে।
হবু মহানগর শিলিগুড়ির অধিকাংশ বড় রাস্তা নিয়ে এমনই ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে বাসিন্দাদের। যে অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের অধিকাংশের কোনও সন্দেহ নেই। অথচ ফুটপাত দখল মুক্ত করার সাধ্য যেন কারও নেই।
যেমন বাম আমলের উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী তথা অশোক ভট্টাচার্যের কথাই ধরা যাক। প্রায় দু’দশকের বেশি সময় ধরে পুর দফতরের দায়িত্বে থেকেও নিজের শহরের ফুটপাত দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করাতে পারেননি। বরং বামেদের হাতে শিলিগুড়ি পুরসভা থাকাকালীন শিলিগুড়ি জংশন লাগোয়া এলাকায় ফুটপাত জুড়ে গড়ে উঠেছে আস্ত একটা মার্কেট। সিপিএমের শিলিগুড়ির সদর দফতর অনিল বিশ্বাস ভবনের আশেপাশে ফুটপাত দখলের প্রবণতা ওই সময়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় বলে অভিযোগ। শিলিগুড়ির কোর্ট মোড়ে এসডিও অফিসে ঢোকার মুখে ফুটপাত বলে কিছু রয়েছে বলে বোঝা দায়। সেখানে ফুল বিক্রেতাদের দখলে গিয়েছে প্রায় পুরোটাই।
কিন্তু, ফুটপাত আটকে এভাবে ব্যবসা করা তো বেআইনি। ইচ্ছে করলেই তো পুরসভা ব্যবস্থা নিতে পারে। জরিমানাও করতে পারে। পুলিশ চাইলে যানজট কমাতে ব্যবস্থাও নিতে পারে। তা হলে সেটা হচ্ছে না কেন? ফুটপাত দখল করে যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদের অনেকেই একান্তে জানান, যাতে কেউ হয়রান না করে সে জন্য রোজ গড়ে ১০ থেকে ৫০ টাকা দিতে হয় ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের একাংশকে। সেই টাকা কে নেন, কোথায় কোথায় যায় তা অবশ্য খোলসা করে কেউ বলতে চান না। উপরন্তু, ফুটপাতে ব্যবসা করেন যাঁরা, তাঁদের দরকার মতো নানা দলের মিটিং-মিছিলে গিয়ে হাজিরা দেওয়াও বাধ্যতামূলক। ফুটপাতের একজন ফলবিক্রেতা জানান, মিটিং-মিছিলের সময়ে অনেক সময়ে কয়েকজন নেতা বাড়তি টাকাও নিয়ে থাকেন।
পুলিশ কী করছে? পুরসভা তো গা ঘেঁষেই? পুরসভার অফিসার-কর্মীরা কী করছেন? ফুটপাতের কয়েকজন বিক্রেতা হাসলেন। তাঁরা প্রায় সমস্বরে পাল্টা প্রশ্ন করেন, পুলিশ-পুরসভা কী নেতাদের সঙ্গে ‘টক্কর’ দেওয়ার সাহস দেখাবে? শুধু তা-ই নয়, তৃণমূল জমানায় পুরসভার একজন তৃণমূল কাউন্সিলর কোর্ট মোড়কে দখল মুক্ত করতে অভিযানে নেমেও পিছু হটতে বাধ্য হন। কারণ, তৃণমূলের আরেক গোষ্ঠীর নেতা তথা কাউন্সিলর ফুটপাত ব্যবসায়ীদের সরানো যাবে না জানিয়ে মিছিল করেন। সেই থেকে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশের আনুগত্য তাঁর দিকেই। অভিযোগ, চাঁদার সিংহভাগ যাচ্ছে সেই নেতার অনুগামী বলে পরিচিতদের পকেটেই। তদুপরি, তৃণমূলের এক নেতার মদতে সিটি অটোর চালক-খালাসিদের দখলে চলে গিয়েছে কোর্ট মোড়ের ফুটপাতের বাদবাকি অংশটুকু। সন্ধ্যার পরে ওই এলাকা যেন ‘মুক্ত শৌচালয়’-এর চেহারা নেয়। দুর্গন্ধে দিনের বেলা সেখান দিয়ে হাঁটা দায়। যা দেখেশুনে কোর্ট মোড়ের নিত্যযাত্রীদের অনেকেরই প্রশ্ন, শিলিগুড়ি পুরসভা কী ঘুমোচ্ছে?
বস্তুত, কোর্ট মোড় থেকে হিলকার্ট রোডের দিকে এগোলে দেকা যাবে ফুটপাত দখলের প্রবণতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। কোথাও ফুলের দোকান। কোথাও রুটি-ঘুগনির স্টল। লটারি-মাদুলি নানা সামগ্রী সাজানো। শিলিগুড়ি হাসপাতালের উল্টোদিকে সারি সারি ওষুধের দোকান। প্রায় সব কটি দোকানের সামনেই লোহার ব্যারিকেড, বেঞ্চ দিয়ে ফুটপাতের প্রায় পুরোটা আটকে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সেখানে ওষুধ ব্যবসায়ীদের মোটরবাইক, ক্রেতাদের যানবাহন থামানোর জায়গা। ওষুধ ব্যবসায়ীদের একাংশ বেআইনি ভাবে ফুটপাত-রাস্তা দখল করলেও পুরসভা নির্বিকার। খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব একদিন ওই সব ব্যারিকেড সরিয়ে ফুটপাত দখল মুক্ত করার অভিযানে নেমেছিলেন। পর দিন ব্যারিকেড সরানো হয়েছিল। ৪৮ ঘণ্টার মাথায় ব্যারিকেড ফিরেছিল। ওষুধ ব্যবসায়ীদের একাংশের দাবি, ব্যারিকেড যাতে না ওঠানো হয়, সেই ব্যাপারে ‘বন্দোবস্ত’ হয়ে গিয়েছে।
হাসমি চক চক পেরিয়ে হিলকার্ট রোডে পা রাখলে আবার ‘মাসিক বন্দোবস্ত’-এর অভিযোগ শোনা যায়। কয়েকজন ফুটপাত ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ফি মাসে নির্দিষ্ট দিনে তাঁদের টাকা দিতে হয়। সেই টাকা যাঁরা আদায় করেন, তাঁরা যাবতীয় ঝক্কি পোহান। এমনকী, ফুটপাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, হিলকার্ট রোডের অনেক বড় দোকানোর মালিক, তাঁর প্রতিষ্ঠানের সামনে বসার জন্য দৈনিক ভিত্তিতে ফুটপাত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। কোথাও দৈনিক ২০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হয় বলে অভিযোগ। হিলকার্ট রোড ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা প্রায় সকলেই অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁদের কোনও সদস্য ফুটপাতের বসার জায়গা দিয়ে দৈনিক কিংবা মাসিক হারে টাকা আদায় করেন না।
তা হলে আমাদের থেকে টাকা কী ভূতে নিচ্ছে? প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে একজন টুপি বিক্রেতা এমনই মন্তব্য করেন। তাঁর টিপ্পনি, “সেবক রোডে গিয়ে দেখুন কী হাল? সেখানে কোন নেতা, কার মাধ্যমে কত টাকা নিচ্ছেন? বিধান মার্কেটের মধ্যে গিয়ে দেখুন ফুটপাত শুধু নয়, রাস্তা দখল করতে হয় কী ভাবে?”
(চলবে)