Advertisement
০৫ মে ২০২৪
৬ নভেম্বর রাসমেলা শুরু

ছেলের হাতেই রাসচক্র তৈরির ভার তুলে দিতে চান আলতাপ

তোর্সার চর লাগোয়া ছোট্ট একটি খাস জায়গায় তাঁর বাড়ি। ছোট ছোট তিনটি ঘরের সামনে কুড়ি ফুট লম্বা দশ ফুট চওড়া উঠোন। তার মধ্যেই বাঁশ চিরে বের করা বাতা থরে থরে সাজানো। বৃষ্টির হাত থেকে সেগুলিকে বাঁচাতে উঠোনের উপর আড়াআড়ি ভাবে একটি ত্রিপল টাঙানো। তাঁর নীচে বসেই রাসচক্র তৈরির কাজ করে চলেছেন আলতাপ মিয়াঁ। তাঁর ঠিক পিছনে বসে বাবাকে সঙ্গত করছেন আমিনুর। বাবার কাছ থেকে শিখেও নিচ্ছেন ঠিক কীভাবে রাসচক্র তৈরি করতে হয়।

কাজে মগ্ন আলতাপ। সঙ্গী ছেলে আমিনুর। নিজস্ব চিত্র।

কাজে মগ্ন আলতাপ। সঙ্গী ছেলে আমিনুর। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কোচবিহার শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৪ ০১:৩৬
Share: Save:

তোর্সার চর লাগোয়া ছোট্ট একটি খাস জায়গায় তাঁর বাড়ি। ছোট ছোট তিনটি ঘরের সামনে কুড়ি ফুট লম্বা দশ ফুট চওড়া উঠোন। তার মধ্যেই বাঁশ চিরে বের করা বাতা থরে থরে সাজানো। বৃষ্টির হাত থেকে সেগুলিকে বাঁচাতে উঠোনের উপর আড়াআড়ি ভাবে একটি ত্রিপল টাঙানো। তাঁর নীচে বসেই রাসচক্র তৈরির কাজ করে চলেছেন আলতাপ মিয়াঁ। তাঁর ঠিক পিছনে বসে বাবাকে সঙ্গত করছেন আমিনুর। বাবার কাছ থেকে শিখেও নিচ্ছেন ঠিক কীভাবে রাসচক্র তৈরি করতে হয়।

আগামী ৬ নভেম্বর এ বার রাসমেলা শুরু হবে কোচবিহারে। তার আগে লক্ষ্মীপুজোর পর থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছেন আলতাপ। ২২ ফুট লম্বা ওই চক্র তৈরি করতে কমপক্ষে ২০ টি বাঁশ প্রয়োজন। চক্রের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী-সরস্বতী, শিব-পার্বতী-সহ ৩২ টি দেবতার ছবি থাকে। তাঁর চারপাশ দিয়ে তৈরি করা হয় নানা রকমের নকশা।

দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ড সূত্রে জানা গিয়েছে, কোচবিহারের রাসমেলায় মদনমোহন মন্দিরের জন্য রাসচক্র তৈরির কাজ বংশ পরম্পরায় করে আসছেন আলতাপ মিয়াঁর পরিবার। দেখতে দেখতে রাসমেলার বয়স দু’শো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আলতাপ মিয়াঁ যতটুকু তাঁর বাবার কাছ থেকে শুনেছেন, বহু বছর আগে রাজার আমলে ভেটাগুড়ি থেকে মদনমোহন মন্দির চত্বর এলাকায় রাসমেলা স্থানান্তরিত হয়। সে সময় তাঁর ঠাকুরদা পান মাহমুদ মিয়াঁ বাঁশের শিল্পী হিসেবে কোচবিহারে নাম করেন। অনায়াসে তিনি বাঁশের একাধিক নকশা তৈরি করতে পারেন। বাঁশ দিয়ে রাসচক্র বানানোর পরিকল্পনা করেন রাজা। খোঁজ পড়ে পান মাহমুদের। সেই থেকে শুরু হয় রাসচক্র তৈরির কাজ। পানের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে আজিজ মিয়াঁ রাসচক্র তৈরির ভার পান। আজিজ মিয়াঁর কাছ থেকে তাঁর ছেলে আলতাপ রাসচক্র বানানোর কাজ শেখেন। বাবার মৃত্যুর পরেও তিনি সেই পরম্পরা বহাল রেখেছেন আলতাপ। দেবোত্তরের পক্ষ থেকে অস্থায়ী হলেও মাসিক অনুদানের ভিত্তিতে রাত পাহারার কাজ দেওয়া হয় আলতাপকে। আর রাসমেলার ঠিক আগে রাসচক্র তৈরি করেন তিনি। রাসমেলা উপলক্ষে ইতিমধ্যেই নতুন করে রং করার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে মদনমোহন মন্দিরে।

আলতাপ মিয়াঁ জানান, ওই চক্র বানানোর জন্য আট হাজার টাকা দেওয়া হয় তাঁকে। পাশাপাশি রাত পাহারার কাজের জন্য মাসে ৫৩০০ টাকা করে পান। ওই টাকায় সংসার চালানো কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানান তিনি। স্ত্রী, ছেলে, বৌমা, দুই নাতি-নাতনি নিয়ে সংসারে অভাব লেগেই রয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেও বংশ পরম্পরায় করে আসা এই কাজ ছাড়তে চান না তিনি। ছেলে আমিনুরও সে ব্যাপারে আগ্রহী। তাই তো বাবার সঙ্গে কাজে নেমেছেন। আলতাপ মিয়াঁ বলেন, “কষ্ট আছে, তা থাকবেও। আশা করব, কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াবে। এই সময়ে সম্প্রীতির বার্তা চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তাই মনে করি, এই কাজ আমাদেরই চালিয়ে যাওয়া উচিত।”

সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে তাঁর ছেলের হাতেই রাসচক্র তৈরির ভার তুলে দিতে চান আলতাপ মিয়াঁ। বলেন, “বাবার হাত ধরে রাসচক্র তৈরির কাজ শিখেছিলাম। ৩২ বছর ধরে নিজেই তৈরি করছি। এক অদ্ভূত আনন্দ পাই। সারা গ্রামের লোক আমার জন্য গর্ব করেন। ছেলের হাতেই এই ভার তুলে দিতে চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rash mela altaf cooch behar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE