কাওয়াখালির এই অঞ্চলে গড়ে ওঠার কথা ফিল্মসিটি। একটি ইটও গাঁথা হয়নি এখনও। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
ডাবগ্রামের একটা বড় অংশ শিলিগুড়ি পুরসভার আওতা ভুক্ত হওয়ার পরে অনেক আশায় বুক বেঁধেছিলেন বাসিন্দারা। সংযোজিত এলাকার বাসিন্দারা ভেবেছিলেন, জমিজমা সহ নানা কারণে জলপাইগুড়ি ছোটাছুটি করার হাত থেকে রেহাই মিলবে। শিলিগুড়ি পুরসভাতে গেলেই সব কাজ হয়ে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি। পুর পরিষেবা ছাড়া অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির বাসিন্দারা এখনও জলপাইগুড়ি জেলা সদরের উপরে নির্ভরশীল। অর্থাৎ বাসিন্দাদের জমিজমা সহ নানা ব্যাপারে প্রশাসনিক ছাড়পত্র পেতে জলপাইগুড়িতে যাতায়াতের ধকল পোহাতেই হচ্ছে।
একই রকম ভাবে বছর দুয়েক আগে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটে গঠনের পরে আশার আলো দেখেছিলেন বাসিন্দারা। বছর দুয়েক আগে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির এলাকার ভক্তিনগর থানা ও এনজেপি ফাঁড়ি শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখনও এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা ভেবেছিলেন, আইনশৃঙ্খলা জনিত কোনও সমস্যা হলে জলপাইগুড়ি জেলা আদালতে ছোটাছুটি করতে হবে না। বাস্তবে তা হয়নি।
তাই বৃহত্তর শিলিগুড়ি নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে লাগাতার আন্দোলন চলছে। সমিতির দাবি, দ্রুত কমিশনারেট এলাকায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত চালু করতে হবে। সরকারি সূত্র অনুযায়ী, কলকাতা হাইকোর্টের অনুমতি ছাড়া তা হবে না। সেই অনুমতি কবে মিলতে পারে সেই প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা কেউ দিতে পারেননি। নাগরিক কমিটির অন্যতম মুখপাত্র রতন বণিকরা কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন। রতনবাবুরা নিয়মিত তা নিয়ে প্রশাসনিক মহলে দরবার করে চলেছেন। রতনবাবু বলেন, “ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষকে যাতে আইনি ব্যাপারে জলপাইগুড়ি জেলা সদরে ছোটাছুটি করতে না-হয়, সে জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাব। শিলিগুড়ি শহরে ওই আদালত হতে পারে। তা যদি নাও হয়, সংযোজিত এলাকায় প্রচুর ফাঁকা জমি রয়েছে। সেখানেও তা করা যেতে পারে।”
বস্তুত, প্রচুর ফাঁকা জমি থাকায় ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে অনেক কিছুই যে করা সম্ভব সে কথা সরকারি কর্তারাও জানেন। সেই কারণে বাম আমলে ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে দুটি ক্ষুদ্র শিল্প তালুক গড়ার কাজ শুরু হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাও হয়েছে সেখানে। কিন্তু, পরিকঠামোর ঘাটতি থাকায় ওই দুটি শিল্প তালুকই নানা সমস্যায় জর্জরিত। ব্যবসায়ী সংগঠন সূত্রেই জানা গিয়েছে, ওই এলাকায় টি-পার্ক গড়ার কাজও থমকে রয়েছে। তৃণমূল রাজ্যের ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে কাওয়াখালি এলাকায় ফিল্ম সিটি গড়ার জন্য ৮৪ একর জমি চিহ্নিত করা হলেও সেখানে একটি ইঁটও গাঁথা হয়নি। ফাঁকাই পড়ে রয়েছে চিহ্নিত জমি। বাম আমলে কাওয়াখালি-পোড়াঝাড়ে উপনগরী গড়ার কাজ থমকে গিয়েছিল অনিচ্ছুক জমিদাতাদের আন্দোলনে। সেই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই তৃণমূল নেতারা গত তিন বছরে কাওয়াখালির উপনগরী গড়ার কাজ এগোতে পারেননি।
এখানেই শেষ নয়। ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে আরও অনেক কাজ নানা টালবাহানায় ঝুলে রয়েছে। যেমন, বাম আমলে ঘটা করে ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে যাতায়াতের পরিকাঠামো তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল। সেটা ছিল ২০১১ সাল। তখন কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার। বাংলাদেশের প্রতিনিধিও ছিলেন অনুষ্ঠানে। ভারত-বাংলাদেশ, দু-তরফেই আশা করা হয়েছিল, দ্রুত পরিকাঠামো তৈরি করে ফুলবাড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে যাতায়াত করার ব্যবস্থা হবে। সেই থেকে ৪ বছর হতে চলেছে। কিন্তু, ফুলবাড়ি সীমান্তে ইমিগ্রেশন চেক পোস্ট (আইসিপি) তৈরির কাজ এগোয়নি। ফলে, পেট্রোপোল, চ্যাংরাবান্ধার মতো জমজমাট সীমান্ত বাণিজ্য কেন্দ্র হতে পারেনি ফুলবাড়ি।
বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, কেন্দ্রের উপরে চাপ বাড়িয়ে কাজটা আদায় করতে পারেনি আগের বাম সরকার। রাজ্যে পরিবর্তনের পরে তৃণমূল জমানায় ফুলবাড়িতে আইসিপি চালু হতে কেন গড়িমসি হচ্ছে, সেই ব্যাপারে মহাকরণ কিংবা নবান্ন থেকে সঠিক ভাবে কিছু জানা যায়নি। কেন্দ্রে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও দিল্লি থেকে ফুলবাড়ি সীমান্তে আইসিপি গড়ার কাজ গতি পায়নি।
এমন নানা প্রকল্প, পরিকল্পনার কথা জানেন ডাবগ্রামের সবিতা সিংহ, দেবাশিস বর্মনের মতো স্নাতক স্তরের পড়ুয়ারাও। ফুলবাড়ির মণিরুল হোসেন, সাজ্জাদ হোসেনের মতো বেকার যুবকেরাও তাই আশায় বুক বেঁধে রয়েছেন। সবিতা, সাজ্জাদররা বললেন, “বড়-বড় প্রকল্প কবে হবে জানি না। কিন্তু, ডাবগ্রামের ইর্স্টা বাইপাস কিংবা ফুলবাড়িতে স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন একটা কলেজ হল না সেটা আমরা বুঝতে পারি না। কেন আমাদের এলাকার ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষার জন্য শিলিগুড়িতে ছুটতে হবে? এটা নেতা-কর্তাদের ভাবা উচিত।”
কলেজের দাবি যে যুক্তিযুক্ত সে কথা সিপিএমের নিউ জলপাইগুড়ি-ফুলবাড়ি জোনাল সম্পাদক দিবস চৌবেও মানছেন। তা হলে তাঁরা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে করাতে পারেননি কেন? দিবসবাবুর যুক্তি, “ফুলবাড়িতে একটি কলেজ তৈরির জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সরকার থাকলে এতদিনে হয়েও যেত।” ওই এলাকার সিপিএমের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের অনেকে দিবসবাবুর যুক্তি মানতে পারেননি। তাঁদের বক্তব্য, এলাকার উন্নয়নের ব্যাপারে দলের নেতারা আন্তরিক থাকলে সিংহভাগ মানুষ বামেদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেন না।
ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকার তৃণমূল বিধায়ক তথা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও এলাকার যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। গৌতমবাবু বলেন, “আমরা ক্ষমতায় আসার পরে ডাবগ্রামে ইস্টার্ন বাই পাসের চেহারা পাল্টে গিয়েছে। ফুলবাড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর শাখা সচিবলায় ‘উত্তরকন্যা’ হয়েছে। ফিল্ম সিটির কাজেও গতি আনার চেষ্টা হচ্ছে। উপরন্তু, ফুলবাড়িকে কেন্দ্রের স্মার্ট সিটি প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য রাজ্যের তরফে সুপারিশ করা হয়েছে।” কিন্তু, ফুলবাড়ি কিংবা ডাবগ্রামে একটা কলেজ হচ্ছে না কেন? উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর আশ্বাস, “ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এলাকায় একটা কলেজ তৈরির কথা ভাবা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব তা করার চেষ্টা হচ্ছে।”
বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা, আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি কিন্তু কম পাননি ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ির মানুষ। তার মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে খুব কম প্রকল্পই। তবে যে দ্রুততার সঙ্গে ‘উত্তরকন্যা’ চালু হয়েছে তাতে কিছুটা হলেও বাড়তি আশার আলো দেখছেন বাসিন্দারা। সেই আশা কবে, কী ভাবে পূরণ হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
(শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy