ধরলা নদীর একপাশে হাওয়া মাথা দোলাচ্ছে কাশের বন। অন্যদিকে নদী ভাঙনের আতঙ্ক ঘুম কেড়েছে বাসিন্দাদের। নদী কারও ভিটেমাটি গিলেছে, কারও বিঘার পর বিঘা কৃষি জমি। নদী ভাঙন বেড়ে চলায় পুজোর আনন্দ ফিকে হয়েছে কোচবিহারের মাতালহাটের বড়ভিটা, মধ্যমনাচিনা গ্রাম থেকে শুরু করে পেটলা, পাটছড়া, গীতালদহের বাসিন্দাদের। বড়ভিটা গ্রামের অন্তত ১০টি বাড়ি ভাঙনের মুখে বলে বাসিন্দারা জানিয়েছেন। একটি মসজিদ এবং হাইস্কুলের খুব কাছ দিয়ে বইছে ধরলা নদী। সেচ দফতরের হিসেব অনুযায়ী, শুধু ধরলা নয়, ধলধলি, সালটিয়া, কালজানি, রায়ডাক, মানসাই, বানিয়াদহ সব নদীতেই কম বেশি ভাঙন চলছে।
জেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মাতালহাট গ্রাম। এলাকার বিভিন্ন গ্রামের অন্তত দু’শো পরিবার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। ফি বছর বর্ষার শুরুতে এবং শেষে দু’দফায় ভাঙন শুরু হয় এলাকায়। এবারেও প্রায় ১০০ বিঘার বেশি কৃষি জমি ধরলা নদীতে তলিয়ে গিয়েছে। বাসিন্দাদের থেকে জানা গেল, গ্রামে প্রতিবারই পুজোর আয়োজন হয়। এবারেও পুজো বন্ধ হবে না বলে বাসিন্দাদের দাবি। তবে তার আয়োজন কতটা হবে তা নিয়েই সংশয়ে রয়েছে সকলে। আগে যেখানে কয়েকশো মিটার দূর দিয়ে নদী বইত, এখন ক্রমশ সরে এসে যোগেন বর্মন, ক্ষিতীশ বর্মনদের বাড়ির কাছে নদী পৌঁছে গিয়েছে। যোগেনবাবুর কথায়, “কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। জমির অনেকটাই তো নদীতে চলে গেল। এবার যদি বাড়িটাও নদী গিলে খায় তবে পরিবার নিয়ে কোথায় যাব। পুজোর মুখে ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় কিনে দেওয়ার টাকাও জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছি।”
পাশেই পেটলা গ্রাম পঞ্চায়েত। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান তপন বর্মন জানিয়েছেন, গত এক মাসে দ্বারিকামারি, দোমুখা, বারোবাংলার ঘাট, রাজাখোলা এলাকায় বুড়া ধরলা এবং সিঙ্গিমারি নদীর ভাঙনে ২৫ টি বাড়ি নদীগর্ভে চলে গিয়েছে। অন্তত ৫০ বিঘা কৃষি জমি নদীতে গিয়েছে। প্রধান বলেন, “ভাঙন কবলিত এলাকাগুলিতে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যাই বেশি। পরিবারগুলি গৃহহীন হয়ে পড়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। তাঁদের প্লাস্টিক সহ ঘর বানানোর জন্য কিছু সহযোগিতা করা হয়েছে। পুজোর প্রস্তুতি চলছে, তবে সেই আনন্দে বাসিন্দারা কতটা মেতে উঠতে পারবেন জানি না।”
ভাঙনের নিয়মিত খবর রাখছেন বলে দাবি করেছেন কোচবিহার জেলা পরিষদের সভাধিপটি পুষ্পিতা ডাকুয়া। নদী ভাঙন রুখতে কোচবিহার ১ নম্বর ব্লকের ঘুঘুমারিতে বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বেশ কয়েকটি এলাকায় নদী ভাঙন রুখতে কাজ শুরু হয়েছে। আরও কিছু কাজ হাতে নেওয়া হবে।” মাতালহাটের জেলা পরিষদের সদস্য তথা বড়ভিটার বাসিন্দা কৃষ্ণকান্ত বর্মন বলেন, “পুজোর মুখে অনেক মানুষ সমস্যায় আছেন। তাঁরা আমার কাছেও এসেছিলেন। দীর্ঘদিনের ওই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ১০ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করে জেলা পরিষদে জমা দেওয়া হয়েছে।”
ভাঙন শুরু হয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকা দিনহাটার গীতালদহেও। এখানেও ধরলা নদী ভাঙন চালাচ্ছে। অন্তত পক্ষে ২ হাজার বাসিন্দা ভিটে হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নদীর আরেক প্রান্তে। জারিধরলা, দরিবস, ভোরামপয়েস্তি, দেওয়ানবস, বাঁধের কুঠি, ভারবান্দা গ্রাম ফি বছর নদী ভাঙনের মুখে পড়ে বলে বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। বছরখানেক আগেই ভাঙনের কবলে পড়ে দরিবসের সেনপাড়ার বাসিন্দা এনসার আলি, শেল্টু সেনরা বাড়ি ছাড়া হয়েছেন। তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন নদীর আরেক প্রান্তে ভারবান্দায়। শেল্টু সেনের কথায়, “ধরলা নদী সব কেড়ে নিয়েছে। বাড়ি-জমি সব ছেড়ে আসতে হয়েছে। আমাদের এখানে এবার পুজো নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy