এই ভাবেই রাস্তার উপর তৈরি হচ্ছে বহুতল। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।
একটা সময়ে জায়গাটার নাম ছিল ‘ভেনাস’ মোড়। এখন ওই এলাকার নাম হাসমি চক। বাম আমলে পুরসভার তরফে ঘটা করে ওই নামকরণ করা হয়েছিল প্রয়াত নাট্যকার সফদর হাসমি স্মরণে। ওই ভেনাস মোড় লাগোয়া ফাঁকা জায়গায় সত্যিকারের ‘চক’ গড়ে উঠবে বলে আশা করেছিলেন শহরবাসী। ভেবেছিলেন, প্রোমোটার-রাজের থাবা থেকে ওই জায়গা রক্ষা করে ছোট্ট পার্ক তৈরি হবে। যেখানে বসার জায়গা ও ছোটখাট পথসভার ব্যবস্থা থাকেবে। ফোয়ারা তৈরি হবে। পায়রা উড়বে। ব্যস্ত রাস্তার পাশে শহরবাসী দু-দণ্ড জিরিয়ে নিতে পারবেন। কলকাতার কার্জন পার্কের মতো বিশাল না হলেও একচিলতে ‘পার্ক’ হবে বলে আশা করেছিলেন শহরবাসী। কিন্তু, বাম আমলেই শহরবাসীর আশায় জল ঢেলে দেন প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য।
তাঁর আমলেই শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এসজেডিএ) ওই ফাঁকা জায়গা রেলের কাছ থেকে লিজ নিয়ে শহরের এক নামী প্রোমোটার সংস্থার হাতে তুলে দেয়। ঘোষণা করা হয়, এসজেডিএ ও শহরের মিত্তল গোষ্ঠীর যৌথ উদ্যোগে ওই এলাকায় পার্কিং প্লাজা হবে। উপরে হবে শপিং মল। সেই মতো কাজ শুরু হয়। তখন কিন্তু ভাবা হয়নি, বিধান রোডের ওই জায়গায় শপিং মল হলে রাস্তা কতটা সঙ্কীর্ণ হয়ে যেতে পারে। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলন করে যুব কংগ্রেস। আন্দোলনের জেরে পাঁচ বছর আগে পুরভোটের আগে তৎকালীন পুরমন্ত্রী অশোকবাবু ওই নির্মীয়মান ভবনের কিছুটা ভেঙে সরানো হবে বলে জানান। সেই মতো নির্মাতা সংস্থা তা ভেঙে সরিয়ে দেয়। এর পরে পুরসভার তরফে নিমার্তা সংস্থার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় বলে অভিযোগ।
ঘটনা হল, ওই বাণিজ্যিক ভবনের কাজ এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে দেখা যাচ্ছে বিধান রোডের ওই অংশে ফুটপাথ বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। শপিং মলের সিঁড়ি যেন রাস্তা থেকে উঠে গিয়েছে। ফলে, পথচারীদের হাঁটতে হচ্ছে ব্যস্ততম রাস্তা বিধান রোড দিয়ে। ফলে, রোজই কমবেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু, বিধান রোডের মতো রাস্তার ফুটপাথ এভাবে বাণিজ্যিক নির্মাতা সংস্থার দখলে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না শহরবাসীদের অনেকেই। ইতিমধ্যেই শিলিগুড়ি নাগরিক সমিতির তরফে তা নিয়ে কনভেনশনের ডাক দেওয়া হয়েছে। সমিতির দাবি, ওই এলাকায় সত্যিকারের ‘চক’ তৈরি করতে হবে। তাই শহরবাসীর পক্ষ থেকে সমিতি ওই এলাকায় বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স নির্মাণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানিয়েছে।
ঘটনাচক্রে, প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোকবাবু এখন খোলাখুলি বারেবারেই বলছেন, ওই জায়গাটা ফাঁকা রাখলেই ভাল হতো। ওই রকম জায়গায় বাণিজ্যিক ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত না নিলেই ভাল হতো। বর্তমান উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব এখন এসজেডিএ-এর চেয়ারম্যান। তিনিও চান ওই এলাকাটি ফাঁকা রাখতে। সে জন্য নির্মাতা সংস্থাকে তাঁদের এ যাবৎ যা টাকা খরচ হয়েছে, সেটা দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবও দিতে চান গৌতমবাবু।
এর পরে জায়গাটি ফাঁকা করে সেখানে চক গড়ে তোলার স্বপ্নও রয়েছে তাঁর। যে নির্মাতা সংস্থা ওই ভবনটি তৈরি করছে তাঁরা অতীতে শহরে বাস টার্মিনাস সহ একাধিক উন্নয়নে সামিল হয়েছে। ফলে, শহরবাসী আশা করছেন, এ ক্ষেত্রেও সংস্থাটি বৃহত্তর শিলিগুড়ির নাগরিকদের কথা মাথায় রেখে বিধান রোডের মতো জায়গায় যাতে হাঁটার জায়গা মেলে সেই ব্যবস্থা করবে। সংস্থার তরফে অবশ্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছে তা পেলে প্রকল্পটি থেকে তাঁরা হাত গুটিয়ে নিতে রাজি আছেন।
এই অবস্থায়, হারিয়ে যাওয়া ফুটপাথ ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে আসরে নেমেছে নাগরিক সমিতি। শিলিগুড়ি নাগরিক সমিতির সভাপতি দুর্গা সাহা বলেন, “ওই এলাকায় এতটুকুও ফুটপাথ নেই। এটা হতে পারে না। আমরা উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর সদর্থক চিন্তাভাবনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। শীঘ্রই কনভেনশন ডাকা হবে। আশা করব, মন্ত্রী শিলিগুড়ি শহরের বাসিন্দাদের এমন একটা চক উপহার দেবেন যা মনে রাখার মতো।”
এই মুহূর্তে কী বলছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী? তাঁর কথায় “আমি তো এসজেডিএ-এর পক্ষ থেকে ওই জায়গাটা ফাঁকা করতে চাই। সে জন্য নির্মাতা সংস্থার যা খরচ হয়েছে দিয়ে দেব। কারণ, আমাদের কাছে জনস্বার্থই সবেচেয়ে বড় ব্যাপার। চেষ্টা তো করছি। দেখা যাক কী কী হয়!”
সেই সঙ্গে মন্ত্রী এটাও জানিয়েছেন, শহরে ফুটপাথ দখল মুক্ত করার জন্য সংশ্লিষ্ট অফিসারদের কাছে পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “কাউকে উচ্ছেদ করা আমাদের নীতি নয়। তা বলে যথেচ্ছ ফুটপাথ দখল করে রাখার প্রবণতাও মেনে নেওয়া যায় না। এটা বন্ধ করতেই হবে।” হিলকার্ট রোড, বিধান রোড, সেবক রোড, কোর্ট মোড়, বিধান মার্কেট, সর্বত্রই ফুটপাথকে নাগরিকদের নির্বিঘ্নে চলাফেরার উপযুক্ত করতে তাঁরা বদ্ধপরিকর বলে দাবি করেছেন মন্ত্রী। পক্ষান্তরে, বিজেপির তরফে জেলা সভাপতি রথীন বসু দাবি করেছেন, তাঁরাও হাসমি চকে ওই ধরনের বাণিজ্যিক নির্মাণের বিরোধী। রথীনবাবুর অভিযোগ, “এমন অপরিকল্পিত কাজকর্মের জন্যই শহরের সঠিক উন্নয়ন হয়নি।” তিনি বলেন, “আমরা পরিকল্পিত উন্নয়নের মাধ্যমে শহরকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছনোর স্বপ্ন দেখি। সেখানে ফুটপাথ দখল কিংবা যথেচ্ছ বেআইনি বাণিজ্যিক নির্মাণের কোনও জায়গা নেই।”
তাই এখন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে শিলিগুড়ি শহরে। যেমন, বাম আমলের হারিয়ে যাওয়া ফুটপাথ কী উদ্ধার হবে? শিলিগুড়ি শহরবাসীর স্বপ্ন ভেনাস মোড়ে খোলামেলা ‘চক’ তৈরি, তা কী পূরণ করতে পারবেন গৌতম দেব? নাকি হাসমি চকের ওই জায়গায় রমরমিয়ে চলবে শপিং মল?
উত্তর মিলতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।
(শেষ)
কেমন লাগছে আমার শহর?
নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-শহরের নাম’।
অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর-শহরের নাম’,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৬/৮৯ চার্চ রোড, শিলিগুড়ি ৭৩৪০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy