Advertisement
E-Paper

বাগান বন্ধ এক দশক, পুজো থামাননি শ্রমিকেরা

নেতা-প্রশাসনের কাছে মাথা কুটে কাজ হয়নি। সকালে ঘুম ভেঙে চা বাগানের শ্রমিকদের ভাবতে হয় সংসার কীভাবে চলবে। তবু পুজো থামাননি তাঁরা। সুদিন ফেরার আশাতেই এখনও দেবী দুর্গার আরাধনা করেন ঢেকলাপাড়ার শ্রমিকেরা।

নিলয় দাস

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:১৬
দিন গুজরানের চিন্তা নিত্যসঙ্গী। পুজোর ক’টা দিন সেই চিন্তাই ভুলে থাকতে চান ঢেকলাপাড়ার শ্রমিকেরা। রাজকুমার মোদকের তোলা ছবি।

দিন গুজরানের চিন্তা নিত্যসঙ্গী। পুজোর ক’টা দিন সেই চিন্তাই ভুলে থাকতে চান ঢেকলাপাড়ার শ্রমিকেরা। রাজকুমার মোদকের তোলা ছবি।

নেতা-প্রশাসনের কাছে মাথা কুটে কাজ হয়নি। সকালে ঘুম ভেঙে চা বাগানের শ্রমিকদের ভাবতে হয় সংসার কীভাবে চলবে। তবু পুজো থামাননি তাঁরা। সুদিন ফেরার আশাতেই এখনও দেবী দুর্গার আরাধনা করেন ঢেকলাপাড়ার শ্রমিকেরা।

ডুয়ার্সের বীরপাড়া থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ওই বাগানে শ্রমিকের সংখ্যা ৬০৪ জন। এক-এক করে বারো বছর ধরে বাগান বন্ধ। অভাবের তাড়নায় অপুষ্টিজনিত নানা রোগে ভুগে কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন বাগানের ১৫০-এরও বেশি বাসিন্দা। রাজ্যে পালাবদলের পরে তৃণমূল সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে একাধিকবার নেতা-মন্ত্রীরা গিয়ে বাগান চালুর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বাগান চালু করার জন্য কোনও মালিক রাজি নন বলে মন্ত্রীরা যুক্তি দিয়েছেন। এখন শ্রমিকদের ভরসা কেবল দশভুজা। বছরভরই ফি মাসে পঁচিশ-তিরিশ টাকা করে জমিয়ে দুর্গাপুজোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

অথচ ছবিটা এমনটা ছিল না। ২০০২ সালের অগস্টে বাগান বন্ধ করে চলে যায় মালিকপক্ষ। বাগান বন্ধের ছ’বছর আগে মালিকপক্ষ পুজো চালু করে। বাগানের নেপানিয়া ডিভিশনের ফুটবল মাঠে তৈরি হতো মণ্ডপ। ষষ্ঠীর দিন সকালে ট্রাক্টরে চাপিয়ে বীরপাড়া থেকে নিয়ে আসা হত প্রতিমা। ধামসা-মাদল আর ঢাকের মিশ্রিত বোলে নেচে উঠত সারা বাগান। বোনাস পেয়ে বাড়ির ছোট-বড় সকলের জন্য শ্রমিকেরা কিনে আনতেন নতুন পোশাক। মণ্ডপে খিচুড়ি ভোগ খেয়ে আনন্দে কখন পুজোর চারটি দিন কেটে যেত তা বোঝাই যেত না। সেই সব আনন্দের দিন আজ অতীত। বাগান বন্ধ হবার পর পর-পর দু’বছর দুর্গাপুজো বন্ধ ছিল। বাগানে সে সময় এক নতুন মালিক পক্ষ মাত্র চার মাসের জন্য বাগান চালু করেন। সে সময় ফের দুর্গাপুজো চালু হয়। তবে ওই মালিক পক্ষ ফের বাগান ছেড়ে চলে যাবার পর আর শ্রমিকেরা দুর্গাপুজো বন্ধ করেননি।

বাগানের চা গাছগুলি বহু পুরনো। একে পুরনো গাছ থেকে পাতা সে ভাবে মেলে না। তার উপরে মালিকপক্ষ বাগান ছাড়ার পর সার, কীটনাশক আর পরিচর্চা না পেয়ে গাছগুলি থেকে একটি কুঁড়ি-দুটি পাতা মেলা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই কাঁচা পাতা তুলে তা বিক্রি করে আয় প্রায় বন্ধের মুখে। একশো দিনের কাজ কোনও মাসে দশ দিন, আবার কোনও মাসে বারো দিন হয়। সে টাকা পেতেও তিন-চার মাস গড়িয়ে যায় বলে অভিযোগ। এমনকী, বন্ধ বাগানের জন্য রাজ্য সরকার যে দেড় হাজার টাকা অনুদান দিয়ে থাকে সে টাকাও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে মেলে না। সংসারের হাল সামলাতে বহু মানুষকে নদীতে গিয়ে পাথর ভাঙতে হচ্ছে। অনেকে পার্শ্ববর্তী ভুটানের পাথর খাদানে গিয়ে দিন মজুরি করছেন। মাঝে মাঝে আবার সে কাজও মেলেনা। বাগানের বাসিন্দারা জানান, এত অভাব সত্যেও ফি মাসে তাঁরা শুধু মাত্র পুজো চালিয়ে যাবার তাগিদে সামান্য টাকা মাসে জমিয়ে রাখেন।

বীরপাড়া হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তথা বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান বিরাজ খড়িয়া, বিকি বরাইকদের মত বাকিদের বাবা-মায়েরাও পুজোয় আর জামা-কাপড় কিনে দিতে পারেননা সন্তানদের। বাগান শ্রমিক সাক্ষী ওঁরাওয়েরর কথায়, “পুরনো জামা কাপড় পড়ে অন্য বাগানে আমাদের পুজো দেখতে যেতে লজ্জা হয়। তাই বাগানেই আমরা ছেলে-পুলেদের নিয়ে পুজো কাটাই।”

তবে আয়োজনের খামতি হারাতে পারেনা আবেগকে। নবমীতে পেট পুরে খিচুড়ি ভোগ খেয়ে ধামসা-মাদলের বোলে কোমর দুলিয়ে রুগ্ন শ্রমিকেরা এ বারও একে অপরের হাত ধরে কোমর দুলিয়ে নেচে, গেয়ে, হুল্লোড় করে সব দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করবেন। এ বারও পুজো শেষ হবে। দাঁত চেপে ফের শ্রমিকেরা শুরু করবেন জীবনের পুজো।

niloy das dheklapara tea garden pujo
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy