(বাঁ দিকে) রাজবাড়ি তখন (ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে)। (ডান দিকে) এখন রাজবাড়িতে চলছে সংস্কার।—নিজস্ব চিত্র।
ঘরের ভেতরে সাজানো ‘রাজপ্রতীক’। ‘রুপোর’ সিংহাসনে বসতেন খোদ মহারাজা। নির্দিষ্ট দিনে মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হত। ফি বছর এপ্রিল মাসে বসত পূণ্যাহ উৎসবের আসর। উৎসবে অংশগ্রহণকারীদের আতর ছড়িয়ে বরণ করা হত। দোতালার ওপরের ‘চিক’ ঘর থেকে রাজ পরিবারের মহিলারাও ওই অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পেতেন। প্রবীণ বাসিন্দা থেকে ইতিহাস গবেষকদের অনেকের আলোচনাতেই কোচবিহার রাজবাড়ির ‘ দরবার হল’ নিয়ে এমন নানা কথা ঘুরে ফিরে উঠে আসে বারবার। কোচবিহারের অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ রাজবাড়ির দরবার হলের প্রতি তাই বাড়তি আকর্শন বাসিন্দা ও পর্যটকদের। রাজবাড়ি বেড়াতে এসে বেশিরভাগ পর্যটকই প্রথমে দরবার হল ঘুরে দেখেন। পুজোর মুখে ওই দরবার হলটিকে নতুন ভাবে সাজিয়ে তুলতে সংস্কার কাজ শুরু করেছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। এজন্য প্রায় দু’ মাস ধরে ঘরের দরজা পর্যটকদের জন্য বন্ধ রয়েছে। এতে বাসিন্দাদের একাংশ তো বটেই পর্যটকদের অনেকেও ব্যাপক ক্ষুব্ধ।
তাঁদের অভিযোগ, দু’মাসের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তদারকিতে চলা দরবার হলের সংস্কার কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। ঢিমেতালে কাজ চলার জন্য সমস্যা হচ্ছে। কবে ওই কাজ সম্পূর্ণ হবে, রাজবাড়ির আধিকারিকরা স্পষ্ট করে জানাতে পারছেননা। ফলে রাজবাড়ি বেড়াতে এসে বন্ধ দরবার হল দেখে অনেকেই ক্ষুব্ধ। কোচবিহার হেরিটেজ সোসাইটির সম্পাদক অরূপজ্যোতি মজুমদার বলেন, “ দরবার হল রাজবাড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। পর্যটকেরা অনেকেই ওই হলঘর ঘুরেই রাজবাড়ির বারান্দা থেকে অন্য অলিন্দ ঘুরে দেখেন। যান অন্য ঘরেও। কাজে গতি এনে দ্রুত কাজ সম্পূর্ণ করে সেটির দরজা ফের পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।” কোচবিহারের বাসিন্দা ইতিহাস গবেষক নৃপেন পাল বলেন, “ দেওয়ালে সাঁটা পাথরের স্তভে আঁকা রাজপ্রতীক দরবার হলের নজর কাড়ত। বিশেষ দিনে রাজকর্মচারীরা সুসজ্জিত পোশাকে সেখানে আসতেন। ফি বছর এপ্রিল মাসে বসত পূণ্যাহ উৎসব। এখনও ওই ঘরে গিয়ে কোথায় মহারাজা বসতেন তা কর্মীদের থেকে অনেকেই খুঁটিয়ে জানতে চান। পুরানো ছবির গ্যালারিতে চোখ রেখে ইতিহাস চাক্ষুষ করতে চান। সেই ঘরটি এতদিন সংস্কারের জন্য বন্ধ থাকাটা ঠিক নয়।”
এএসআই সূত্রে জানা গিয়েছে, শতবর্ষ প্রাচীন কোচবিহার রাজবাড়ির ওই দরবার হলটি দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ধুঁকছিল। পলেস্তরা খসে পড়ায় ও রঙ ফিকে হয়ে যাওয়ায় অনেকেই আক্ষেপ করতেন। এবছর জানুয়ারি মাসেই ওই দরবার হলটি সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় এএসআই। এজন্য দু’ মাস দরবার হলটি বন্ধ রাখার ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিও জারি করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গত জুন মাসে রাজবাড়ির ওই দরবার হলের সংস্কার কাজ শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে ওই সংস্কার কাজের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ১০ লক্ষাধিক টাকা। এএসআইয়ের কয়েকজন কর্মী জানান, প্রাথমিকভাবে দুই মাসের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ শুরুর পর দেখা যায় প্রায় ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য, ৯০ ফুট প্রশস্থ ও ১২০ ফুট উচ্চতার ওই ঘরের খোলনলচে বদলে সংস্কার জরুরী। বিশাল লোহার রেলিং তৈরি করে কাজ হচ্ছে। কিন্তু প্রসাদের সুক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকাজ, চুনের প্রলেপ থেকে রঙতুলির টানে বাড়তি সময় লাগছে। এএসআইয়ের রাজবাড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক আধিকারিক পঙ্কজ দাস বলেন, “ দ্রুত ওই কাজ সম্পূর্ণ করার চেষ্টা হচ্ছে।”
দরবার হলের নানা স্মৃতি যাদের চোখে এখনও টাটকা, কোচবিহার রাজ পরিবারের দুয়ারবক্সি প্রবীণ অমিয় দেববক্সী তাঁদের অন্যতম। দরবার হলের প্রসঙ্গ উঠতেই রীতিমতো নস্টালজিক হয়ে পড়েন তিনি। অমিয়বাবু বলেন, “ ঘরের পশ্চিম দিকে মহারাজা রুপোর সিংহাসনে বসতেন। বিশেষ দিনে দরবারে এসে প্রজারা ‘নজর’ দিত। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের আমলেও নানা অনুষ্ঠান হত। আমি নিজে দেখেছি। ফলে দরবার হলের প্রতি টান বরাবর আলাদা।” ১৮৮৭ সালে কোচবিহার শহরে বিশাল এলাকা নিয়ে রাজবাড়ি তৈরি হয়। মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের আমলে তৈরি ওই প্রাসাদ এখনও জেলার পর্যটনের অন্যতম আকর্শন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy