Advertisement
১৭ মে ২০২৪

লালমোহনের টানে ফুলবাড়ি এসেছেন হেমন্তও

পূর্ণিমার রাতে বাড়ির দাওয়ায় বসে দেখা যেত দুলকি চালে হাঁটছে আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। দল বেঁধে হাতির পাল ঢুকে সাহু নদীর জল উথালপাথাল করে স্নান করত। কখনও শেয়ালেরা চুপিসাড়ে ঢুকে হাঁস-মুরগি নিয়ে দে ছুট। কচিকাঁচারা সভয়ে সে দৃশ্য দেখে হাত চেপে ধরত বড়দের। ৯৬ বছর বয়সেও স্মৃতি হাতড়ে এমন নানা দৃশ্যের বর্ণনা নিখুঁতভাবে করতে পারেন ডাবগ্রামের নেতাজি কলোনির বাসিন্দা হারানচন্দ্র রাউত।

তৈরি হচ্ছে লালমোহন।

তৈরি হচ্ছে লালমোহন।

কিশোর সাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০১:৫৮
Share: Save:

পূর্ণিমার রাতে বাড়ির দাওয়ায় বসে দেখা যেত দুলকি চালে হাঁটছে আস্ত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। দল বেঁধে হাতির পাল ঢুকে সাহু নদীর জল উথালপাথাল করে স্নান করত। কখনও শেয়ালেরা চুপিসাড়ে ঢুকে হাঁস-মুরগি নিয়ে দে ছুট। কচিকাঁচারা সভয়ে সে দৃশ্য দেখে হাত চেপে ধরত বড়দের। ৯৬ বছর বয়সেও স্মৃতি হাতড়ে এমন নানা দৃশ্যের বর্ণনা নিখুঁতভাবে করতে পারেন ডাবগ্রামের নেতাজি কলোনির বাসিন্দা হারানচন্দ্র রাউত।

খাতায়-কলমে শিলিগুড়ির পুরসভার সংযোজিত এলাকার ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের নাম নেতাজি কলোনি হতে পারে। কিন্তু এলাকায় অনেক দোকানের বোর্ডেই লেখা রাউতপাড়া। একটু পুরোনো লোকজন রাউতপাড়া হিসেবেই চেনেন জায়গাটাকে। কারণ ওই অশীতিপর রাউতবাবুই। যিনি ১৯৬৪ সালে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে ময়মনসিংহ থেকে এসে ছোট্ট একটা একচালা ঘর বানিয়ে কলোনির পত্তন করেছিলেন। তখন ঘরদোরের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। মূলিবাঁশের বেড়া আর পাতির ছাউনি দিয়ে ঘেরা ঘর। বাড়ির অদূরে সাহু নদী। কাছেই বৈকুণ্ঠপুরের ঘন জঙ্গল। ধীরে ধীরে ঢাকা, বিক্রমপুর, ফরিদপুর থেকে অনেক লোকজনের আনাগোনা হল। হারানবাবুরা ছোটাছুটি করে কলোনি তৈরি করলেন। সে কাজে কারা সাহায্য করেছেন, আন্দোলনে কারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে কথা বলতে গিয়ে ঝুলি হাতড়ে যে কটি নাম বলেছেন হারানবাবু, তাঁদের অনেকেই প্রয়াত। অনেকে বেঁচে আছেন। কিন্তু বয়সের ভারে তাঁদের অনেকেই কিন্তু হারানবাবুর মতোই কাবু।

শিলিগুড়ির গা ঘেঁষে থাকা ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি দুটি লাগোয়া গ্রামের ধীরে ধীরে শহুরে আদলে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় অবদান রয়েছে আরও অনেকেরই। যেমন ৯৪ বছর বয়সী অঘন সিংহ রায়। থাকেন জলেশ্বরীতে। তাঁর মায়ের নাম জলেশ্বরী। মায়ের নামে বাজার গড়তে বড় মাপের জমি দিয়েছেন তিনি। একটা সময়ে এলাকায় শতাধিক পুকুর থাকলেও এখন রয়েছে একটিই। সেটি হল চন্দ্রপুকুর। সেটিও অঘনবাবুদের বাড়ির গা ঘেঁষেই। এলাকার বনেদী পরিবারের মানুষটি চেনাজানা লোকজনদের ডেকে ডেকে সস্তায় জমি দিয়ে বসতি গড়েছেন। জীবন সায়াহ্নে পৌঁছলেও এতটুকুও ক্লান্তি নেই। এখন কেউ বিপদে পড়লে তাঁর পাশে দাঁড়াতে ছুটে যান। সোমবারই তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলেনি। তাঁর ছেলে মানিক জানালেন, বাবা বাজারের দিকে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে জানা গিয়েছে, বাজারের কাউকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। তাঁকে ছাড়াতে বাসে চড়ে জলপাইগুড়ি আদালতে রওনা হয়েছেন। সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলেন অঘনবাবু বলেছেন, “থামলে তো থেমেই যাব। তাই চলাটা কখনও বন্ধ করতে চাই না। চলাটা থামাইনি বলেই তো সে দিনের ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি এখন ঝকঝকে শিলিগুড়িকে টেক্কা দিতে কোমর বাঁধছে।” বস্তুত, শালুগাড়া থেকে শুরু করে আশিঘর মোড়, কানকাটা মোড়, চিকা মোড়, গোরার মোড় পেরিয়ে এনজেপি ছুঁয়ে তিনবাতি পেরিয়ে ফুলবাড়ি পর্যন্ত যে বিস্তীর্ণ এলাকা তা যেন রোজই বদলাচ্ছে। ইতিমধ্যেই ডাবগ্রামের একটা বড় অংশ শিলিগুড়ি পুরসভার সংযোজিত এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রাস্তাঘাটের ভোল পাল্টেছে। নিকাশির বেহাল দশাও অনেকটা ঘুচেছে। ইস্টার্ন বাইপাস হয়েছে আগের চেয়ে ঝকঝকে। আগামী দিনে তা আরও প্রশস্ত করার পরিকল্পনাও হচ্ছে।


ফুলবাড়ি ব্যারাজ।

এত বদলের মধ্যেই অপরিবর্তিত কিছুই কি নেই? ফুলবাড়িতে গেলে এলাকার বাসিন্দারা হইহই করে জানিয়ে দেন, ‘আছে। আছে।’ তা হল ফুলবাড়ির লালমোহন। শহুরে পরিভাষায় যা কি না পান্তুয়া হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ৬০ বছর আগে ঢাকা থেকে এসে ফুলবাড়িতে যিনি ওই মিষ্টি বানানো শুরু করেছিলেন, সেই প্রয়াত মণীন্দ্রনাথ ঘোষ বলতেন, ‘না, এটা পান্তুয়া নয়। এটা লালমোহন হিসেবেই পরিচিতি পাক। সেটাই আমি চাই।” এখন মণীন্দ্রবাবুর ছেলে রতনবাবু সেই নরম-তুলতুলে ‘লালমোহন’ তৈরি করেন। বাবার মতোই তিনিও ভোরবেলা উঠে কয়েক কড়াই লালমোহন বানান। যার টানে দিনভর ফুলবাড়ি মোড়ের দোকানে রসিকজনের আনাগোনা চলে।

দোকানের অটোগ্রাফ খাতা অনুযায়ী, ‘লালমোহন’-এর টানে প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার মিষ্টি খেয়েছেন। রঞ্জিত মল্লিক, তাঁর মেয়ে কোয়েল, মিঠুন চক্রবর্তী, উষা উত্থুপ, সব্যসাচী চক্রবর্তী, কতজনের নাম, কে কটা লালমোহন খেয়েছেন, সেই হিসেবও আবছা দিতে পারে ঘোষ পরিবার। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় দোকানের সামনে শু্যটিং করেছেন বলেও জানালেন তাঁরা। কয়েক বছর আগে মণীন্দ্রবাবুর আর এক ছেলেও লালমোহনের দোকান খুলেছেন ওই মোড়েই।

তাই ফুলবাড়ি মোড়ে দাঁড়িয়ে প্রবীণ বাসিন্দা মামুদ হোসেন বললেন, “আগের মতো বাঘ আর ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে নেই। লোকজন, যানবাহন বেড়ে যাওয়ায় ফুলবাড়ির ব্যারাজে আগের চেয়ে কম পাখি আসে। হু হু করে ফ্ল্যাটবাড়ি, আবাসন হচ্ছে অনেকে। জায়গাটা পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু সব কিছু পাল্টালেও ফুলবাড়ির লালমোহনের স্বাদ এতটুকুও পাল্টায়নি। বাংলাদেশের রংপুর থেকে আত্মীয়-স্বজনরা এলেও ওই মিষ্টি খাবেই।”

অবশ্য ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি মানেই শুধু মিষ্টি-মিষ্টি ব্যাপার তা কিন্তু একদম নয়। বরং অনেক তিতকুটে বিষয়ও আছে। (চলবে)।

ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kishore saha siliguri
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE