Advertisement
০১ মে ২০২৪

বদলে গিয়েছে বেড়ানোর মানে, রাজ্যের ভাবনা বদলাবে কি

শীতের মেচি নদীতে জল নেই। সাদা নুড়িতে ভরা শুকনো নদীখাত। সেই খাত দিয়েই গোঁ গোঁ আওয়াজে ছুটছিল একের পর এক র‌্যালির গাড়ি। দৈত্যের মতো গতি। নদীর ও-পারের কুয়াশার সঙ্গে গাড়ির চাকায় উড়তে থাকা ধুলো মিশে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার জোগাড়।

দক্ষিণ খয়েরবাড়ির জঙ্গলপথে র‌্যালির গাড়ি। ছবি: দেবাশিস রায়।

দক্ষিণ খয়েরবাড়ির জঙ্গলপথে র‌্যালির গাড়ি। ছবি: দেবাশিস রায়।

সুজিষ্ণু মাহাতো
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:০৫
Share: Save:

শীতের মেচি নদীতে জল নেই। সাদা নুড়িতে ভরা শুকনো নদীখাত। সেই খাত দিয়েই গোঁ গোঁ আওয়াজে ছুটছিল একের পর এক র‌্যালির গাড়ি। দৈত্যের মতো গতি। নদীর ও-পারের কুয়াশার সঙ্গে গাড়ির চাকায় উড়তে থাকা ধুলো মিশে চোখে ধাঁধা লেগে যাওয়ার জোগাড়।

শিলিগুড়ির অদূরে এই মেচি নদী লাগোয়াই নেপাল সীমান্ত। চাঁদনি রাতে এই নদীখাত পেরিয়েই দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি এলাকায় ঢোকে হাতির পাল। রাজ্য পর্যটন দফতরের সহায়তায় সম্প্রতি হয়ে যাওয়া গাড়ির র‌্যালি ‘হিমালয়ান ড্রাইভ’-এর ৭০০ কিলোমিটার পথের খানিকটা ছিল এই নদীখাতের উপর দিয়েই। শিলিগুড়ি থেকে সাংবাদিকদের নিয়ে আসা এসইউভি-র চালক বলছিলেন, “জন্ম থেকে শিলিগুড়িতে আছি। এত কাছে এমন পথ রয়েছে তা-ই জানতাম না!” ভুল ভাঙালেন আয়োজক সংস্থার কর্তা তমাল ঘোষাল, “এটা তো গাড়ি চলার পথ নয়। রিভারবেড দিয়ে র‌্যালির পথ তৈরির জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিশেষ অনুমতি নিতে হয়েছে।” শুধু শুকনো নদীখাতই নয়, গাড়ি ছুটেছে দক্ষিণ খয়েরবাড়ির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, জংলা ঝোরার জল ছিটিয়েও।

অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের হাত ধরেই হয়তো সম্ভব চেনা পথের বাইরে এত অজানা জনপদ ছুঁয়ে বেড়ানো। হিমাচলপ্রদেশ ও জম্মু-কাশ্মীরের পাহাড়ি পথ চিরে যাওয়া ‘রেড দ্য হিমালয়’ র‌্যালির কথাই ধরা যাক। সেই র‌্যালির আসর বসছে পনেরো বছর হয়ে গেল। শিমলায় শুরু হয়ে হিমালয়ের একাধিক দুর্গম গিরিপথ পার করে র‌্যালি শেষ হয় শ্রীনগরে। যোগ দেন বহু বিদেশি পর্যটক। গত কয়েক বছরে হিমাচলপ্রদেশ হয়ে শুকনো, পাথুরে হিমালয়ের পথ দিয়ে লাদাখ যাওয়ার চল বেড়ে যাওয়া, এমনকী লাদাখের বলিউড-গন্তব্য হয়ে ওঠার একটা বড় কারণ যে এই র‌্যালি, তা মানেন ওই দুই রাজ্যের পর্যটন ব্যবসায়ীরাও। শুধু গাড়ি নয়, এই পথে র‌্যালি করায় বহু বড় মোটরবাইক ব্র্যান্ডও। উত্তরাখণ্ড সরকারও রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো ছুঁয়ে র‌্যালির আয়োজন করে। রাজস্থানের মরুভূমিতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতের কচ্ছের রণেও বসে মোটর র‌্যালির আসর।

এ সবের লক্ষ্য একটাই— আরও বেশি পর্যটক টেনে আনা। উত্তরবঙ্গের ওই র‌্যালির আয়োজক সংস্থার অন্যতম কর্তা দেবজিৎ চৌধুরী বলছিলেন, “র‌্যালি ও অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের চল যত বাড়বে, লাগোয়া এলাকার অর্থনীতি ততই সমৃদ্ধ হবে।” সোজা হিসেব। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের টানে বিদেশি পর্যটকেরা তো ভিড় জমাবেনই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ভারতীয়দের মধ্যেও ছুটি কাটানোর সংজ্ঞাটা বদলে গিয়েছে। কর্পোরেট জীবনযাপনে অভ্যস্ত তরুণ প্রজন্মের কাছে এখন খরস্রোতা নদীতে র‌্যাফটিং, প্যারাগ্লাইডিং, স্কুবা ডাইভিং, বাঙ্গি জাম্পিং, ট্রেকিং কিংবা ওই মোটরবাইক বা কার র‌্যালির টান অনেক বেশি। এমনকী মধুচন্দ্রিমার প্যাকেজেও তরুণ প্রজন্ম অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস চাইছে! ইস্টার্ন হিমালয়া ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সভাপতি সম্রাট স্যান্যালের কথায়, “এখন অনেক বেসরকারি সংস্থাই ট্যুরিস্ট স্পটে কনফারেন্স করে। তার সঙ্গে থাকে নানা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের সুযোগ। উত্তরবঙ্গেও একাধিক অ্যাডভেঞ্চার রিয়্যালিটি শোয়ের শ্যুটিং হয়েছে। সেগুলো আরও বেশি করে হলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে।”

কিন্তু তার জন্য রাজ্য সরকারকেও পর্যটন নিয়ে নিজস্ব ধ্যান-ধারণাগুলো একটু ঢেলে সাজতে হবে। উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে একাধিক বার বিভিন্ন জায়গার ছবি আইপ্যাডে তুলে সেখানে হোটেল-রিসর্ট বানানোর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিতে দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কিন্তু পর্যটন ব্যবসায়ীদের মতে, বেড়ানোর ধরন যখন বদলাচ্ছে, তখন শুধু হোটেলের সারি আর দু’একটা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের আসর বসালেই রাজ্যের ঘরে লাভের কড়ি আসবে না। আগে গোটা ব্যবস্থাটাকেই পর্যটক-বান্ধব করতে হবে। দরকার নিজস্ব প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ বিপণনও।

ঠিক এই জায়গাটাতেই পশ্চিমবঙ্গকে টেক্কা দিচ্ছে অন্যান্য রাজ্য। মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, কেরল বা গোয়ার পর্যটন দফতরের সাইট অনেক বেশি আকর্ষণীয় ও ‘ইউজার-ফ্রেন্ডলি’। পর্যটকেরা সেখানে বিশেষ আকর্ষণীয় জায়গাগুলির যাবতীয় তথ্য-ছবি তো পান-ই, সেই সঙ্গে ওই সাইট থেকেই ‘এক জানলা ব্যবস্থা’র মাধ্যমে তাঁরা অনায়াসে বুক করে ফেলতে পারেন হোটেল, গাড়ি থেকে শুরু করে পছন্দের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস। পর্যটন ব্যবসায়ীদের পরামর্শ, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের গোটা বিষয়টি রাজ্য সরকারই দেখুক। তৈরি করুক অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের বার্ষিক ক্যালেন্ডার। তাতে বছরের গোড়াতেই প্রধান আকর্ষণগুলি জানতে পারবেন দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা। সেই মতো স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরাও তাঁদের প্যাকেজ তৈরি করতে পারবেন।

এর পাশাপাশি বিদেশি ও উচ্চবিত্ত পর্যটক টানতে আরও কয়েকটি বিষয় এখন প্রায় অবশ্য-প্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন অধিকাংশ ট্যুরিস্ট স্পটে হেলিপ্যাড, গল্ফ কোর্স, স্পা, যোগব্যায়াম সেন্টার। কিন্তু প্রশ্ন হল, পশ্চিমবঙ্গে এই সমস্ত পরিকাঠামো নির্মাণে লগ্নি করবে কে?

শিল্পমহলের একটা বড় অংশই মনে করেন, এই রাজ্যে এখন লগ্নি-সহায়ক পরিবেশ নেই। এক দিকে রয়েছে জমি অধিগ্রহণে রাজ্যের অনীহা, অন্য দিকে সিন্ডিকেট ও শাসক দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর জুলুম। তা ছাড়া, রাজ্য সরকারের নয়া পর্যটন নীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। সম্প্রতি নতুন ‘ট্যুরিজম ইনসেন্টিভ পলিসি’ বা ‘পর্যটন উৎসাহ নীতি’ তৈরি করেছে রাজ্য। পর্যটন দফতর সূত্রের খবর, এই উৎসাহ ভাতা প্রকল্পে ‘বিশেষ’ এলাকায় (জঙ্গলমহল ও সুন্দরবন) ১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লগ্নি করলে সরকার ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেবে। সেই সঙ্গে ব্যাঙ্ক বা অন্য কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের সুদের উপরে ভর্তুকি মিলবে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। বিশেষ এলাকায় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে লগ্নি করলে ভ্যাট বা মূল্যযুক্ত করের পুরোটাই মকুব করা হবে।

কিন্তু নবান্ন সূত্রেই বলা হচ্ছে, এর সঙ্গে বাম-আমলে তৈরি পর্যটন নীতির বিশেষ ফারাক নেই। পর্যটনে বেসরকারি বিনিয়োগ টানতে ২০০৮-এ ‘উৎসাহ ভাতা’ ঘোষণা করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। এ বার কার্যত সেটাকেই নতুন মোড়কে তুলে ধরা হয়েছে বলে দাবি পর্যটন ব্যবসায়ীদের একাংশের।

তাই তাঁরা মনে করছেন, ‘উৎসাহ ভাতার’ টোপ নয়, আগে পর্যটন নিয়ে রাজ্যের ধ্যানধারণা আমূল বদলানো দরকার। রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানান, অ্যাডভেঞ্চার-পর্যটন নিয়ে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ যে বাড়ছে, সে সম্পর্কে রাজ্য সরকার অবহিত। সেই জন্যই তিস্তায় র‌্যাফটিং বা দিঘায় প্যারাগ্লাইডিং চালু করতে উদ্যোগী হয়েছে সরকার। তাঁর কথায়, “অনেক বেসরকারি সংস্থা এই ধরনের র‌্যালি ও অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম নিয়ে আগ্রহ দেখায়। যারা তা যথাযথ ভাবে করতে পারবে, সরকার তাদের তুলে ধরছে ও ভবিষ্যতেও তুলে ধরবে।” কিন্তু অন্যান্য রাজ্য যখন অনেক এগিয়ে গিয়েছে, তখন প্রচারের বিষয়টি নিয়ে কী ভাবছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার? ব্রাত্যবাবু জানান, সরকার বিভিন্ন বিষয়ে প্রচার করে চলেছে। ওয়েবসাইটেও আরও অনেক বেশি তথ্য দেওয়া হবে।

ফেলুদা তোপসেকে বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গ হল ‘অ্যাক্সিডেন্ট অব জিওগ্রাফি’। কারণ, একই রাজ্যে পাহাড়-সমুদ্র সচরাচর দেখা যায় না। তাই এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনে আরও বিনিয়োগ ও লাভের মুখ দেখুক রাজ্য, সেটাই আশা সকলের।

এখন আশা কবে পূরণ হয়, সেটাই দেখার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE