Advertisement
০৪ মে ২০২৪
বেহাল রাজ্য জুড়ে

দশ শয্যা নিয়ে নড়বড়ে দাঁতের চিকিৎসা, ভোগান্তি

দুর্ঘটনায় চোয়াল-থুতনি-গাল ভেঙে দলা পাকিয়ে যাওয়া রোগীকে নিয়ে বাড়ির লোক পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন অস্ত্রোপচারের জন্য! দাঁত ও মাড়িতে ক্যানসার হয়ে যাওয়া রোগী অস্ত্রোপচারের জন্য কোথাও ভর্তি হতে পারছেন না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৪৭
Share: Save:

দুর্ঘটনায় চোয়াল-থুতনি-গাল ভেঙে দলা পাকিয়ে যাওয়া রোগীকে নিয়ে বাড়ির লোক পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন অস্ত্রোপচারের জন্য! দাঁত ও মাড়িতে ক্যানসার হয়ে যাওয়া রোগী অস্ত্রোপচারের জন্য কোথাও ভর্তি হতে পারছেন না, মৃত্যু ক্রমশ এগিয়ে আসছে! চোয়াল ও দাঁতের জন্মগত বিকৃতির জন্য খাবার চিবিয়ে খেতে পারেন না রোগী। ভাল করে কথাও বলতে পারেন না। তিন বছর ধরে অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে নাম লিখিয়েও তারিখ মিলছে না!

কারণ গোটা পশ্চিমবঙ্গে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ মিলিয়ে রোগী ভর্তির জন্য শয্যা সাকুল্যে ১০টি। আর অপারেশন থিয়েটারের সংখ্যা ১! নেই আইসিসিইউ!

২০১৭-এ দাঁড়িয়ে একটি রাজ্যে এই পরিকাঠামো নিয়ে কী ভাবে চিকিৎসা সম্ভব, তা জানতে চেয়ে সম্প্রতি স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি দিয়েছেন আর আহমেদ ডেন্টাল কলেজ-এর কয়েক জন সিনিয়র চিকিৎসক। তাঁদের প্রশ্ন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর উন্নয়ন হলে দাঁতের চিকিৎসার শোচনীয় অবস্থা কী করে স্বাস্থ্যকর্তাদের নজর এড়ায়? তাঁদের দাবি, অতীতেও একই কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, লাভ হয়নি। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, তিনি চিঠি পাননি।

পাশাপাশি অবশ্য ত্রুটি স্বীকার করে সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘কোনও রাজ্যে দাঁতের চিকিৎসার এত খারাপ পরিকাঠামো হতে পারে না। আসলে দাঁতের ব্যাপারটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ডেন্টাল সার্জনকে সহযোগিতা করার জন্য জেনারেল সার্জন, অ্যানাসথেটিস্ট বা ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ এখন দিতে বললে আমাদের পক্ষে দেওয়া কঠিন। লোক নেই। তবে সেটা কোনও যুক্তি হতে পারে না। আমি বিষয়টি দেখছি।’’

এই আশ্বাসে অবশ্য চিঁড়ে ভিজছে না। চিকিৎসকদের কথায়, ‘‘না আঁচালে কিছুই বিশ্বাস নেই। যাঁরা স্বাস্থ্য ভবনে বসে থাকেন, তাঁদের তো চোখের সামনে কাতরাতে থাকা রোগীদের দেখতে হয় না, তাঁদের পরিজনদের গালিগালাজ শুনতে হয় না, মরণাপন্ন ক্যানসার রোগীদের রেফার করে দেওয়ার সময়ে লজ্জায়-গ্লানিতে জর্জরিত হতে হয় না। তাই তাঁরা সব ভুলে যেতে পারেন।’’

আর আহমেদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তাঁদের ওখানে শুধু আউটডোরেই প্রতিদিন দুই-আড়াই হাজার রোগী আসেন। এঁদের অর্ধেকেরও যদি অস্ত্রোপচার লাগে, তার জন্য সরকারি ক্ষেত্রে গোটা রাজ্যে বরাদ্দ ওই ১০টি শয্যা! এই মুহূর্তে ওই হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষমানদের তালিকায় দুর্ঘটনাগ্রস্ত রোগী রয়েছেন ৮০ জন, ক্যানসার আক্রান্ত ৪০ জন ও টিউমার-আক্রান্ত ৯০ জন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন যত জনের বায়োপ্‌সি হচ্ছে, গড়ে ৩ জনের দাঁত বা মাড়ির ক্যানসার ধরা পড়ছে ও পত্রপাঠ তাঁদের চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে রেফার করা হচ্ছে। সেখানে এত রোগীর চাপ, অধিকাংশই ভর্তি হতে পারছেন না। তখন শুরু হচ্ছে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ধাক্কা খাওয়া।

চিকিৎসকেরা আরও বলছেন, ‘‘শয্যা, ওটি ও আইসিইউ পেলে আমাদের সার্জনরাই ক্যানসার রোগীদের অস্ত্রোপচার করতে পারতেন। এখন কারও অস্ত্রোপচার করলেও ভয়ে থাকি। অস্ত্রোপচারের পরে রোগীকে আইসিইউ-তে রাখা যায় না। যে কোনও মুহূর্তে তাঁর অবস্থার অবনতি হতে পারে।’’ প্রসঙ্গত, আর আহমেদ ছাড়াও রাজ্যে উত্তরবঙ্গ ও বর্ধমানে আরও দু’টি সরকারি ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজ আছে। কিন্তু তার কোনওটিতেই শয্যা নেই! রোগী দেখতে পড়ুয়া-ডাক্তারেরা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল বা বর্ধমান মেডিক্যালে যান। আবার, মেডিক্যাল কলেজগুলিতে দাঁতের আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু এসএসকেএম-সহ কোথাও সেখানে রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা হয় না!

নড়বড়ে পরিকাঠামোর কথা মেনে নিয়ে রাজ্যের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা (দাঁত) প্রদ্যোৎ বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘‘আসলে দাঁতের রোগী ভর্তির জন্য শয্যা রাখার চল বহু দিন পর্যন্ত কোনও রাজ্যেই ছিল না। তার পরে অন্য রাজ্য সেটা করতে পেরেছে। আমরা একটু পিছিয়ে পড়েছি।’’ তাঁর কথায়, ‘‘আর আহমেদ হাসপাতালের নতুন ভবনটি তাড়াহুড়ো করে শয্যা না-বাড়িয়েই চালু করাই ভুল হয়েছিল। যাই হোক, ওই ভবনের তিনতলা থেকে মাড়ির বিভাগটি খুব তাড়াতাড়ি পুরনো বাড়িতে চলে আসছে। ওই জায়গায় অন্তত ৫০টি শয্যা, ওটি ও আইসিইউ করা যাবে। পুরনো ভবনের পাশেও কিছুটা জমি আছে। ওখানেও বাড়ি তৈরি করে কিছু শয্যা রাখা যায় কি না, দেখা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dental Hospital Mismanagement Patients harassment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE