মধ্যমগ্রাম রেল স্টেশনে বনধের প্রতিবাদে তৃণমূল সমর্থকদের মিছিল। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ধমর্ঘট। ধর্মঘট ভাঙতে আবার সন্ত্রাস!
বামফ্রন্ট ও বিজেপি-র ডাকা ধর্মঘটের দিন সকাল থেকে এমন ছবিই দেখা গেল রাজ্য জুড়ে। নানা জেলায় শাসক দলের হাতে বিরোধী সমর্থকদের আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ উঠল। সেই সঙ্গেই চলল পুলিশি ধরপাকড়। ধর্মঘট ব্যর্থ করতে পুলিশ-প্রশাসন যে সক্রিয় থাকবে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশেই তা পরিষ্কার ছিল। শাসক দল তৃণমূলের তরফেও জানানো হয়েছিল, তাদের দলের কর্মী-সমর্থকেরা রাস্তায় নেমে ধর্মঘটের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে যে ভাবে নানা জায়গায় ধর্মঘট ভাঙার নামে বাম ও বিজেপি-র কর্মী-সমর্থকদের মারধর করা হয়েছে, সাম্প্রতিক কালে কোনও বন্ধ ঘিরে এমন ছবি যথেষ্টই নজিরবিহীন! কোথাও বিরোধীদের মিছিলে হামলা হয়েছে, কোথাও বিরোধীদের দলীয় কার্যালয়ে চড়াও হয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে, কোথাও আবার থানার সামনেই বেধড়ক পেটানো হয়েছে ধর্মঘট সমর্থনকারীদের। কলকাতার কলেজ স্ট্রিট বা হাওড়ায় সরকারি বাসে আড়াল থেকে ঢিল মারার অভিযোগ বিরোধীদের দিকে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু হাওড়ার কোনায় ধর্মঘটে বাস না নামানোর অভিযোগে পর পর মিনিবাসে ভাঙচুর চালিয়ে সেই অভিযোগ ছাপিয়ে গিয়েছেন ধর্মঘট-বিরোধীরাই!
এ সবের মধ্যেও ধর্মঘটে অবশ্য সাড়া মিলেছে ভালই। রাজ্য সরকার তাদের ঘোষণা মতো সরকারি বাস ও ট্রাম চালিয়েছে প্রচুর। রাস্তায় বেরিয়েছে বেশ কিছু বেসরকারি বাসও। কিন্তু তাতে যাত্রী ছিল কম। রেল ও মেট্রো পরিষেবা চালু থাকলেও সেখানে অন্যান্য কাজের দিনের তুলনায় ভিড়ের চাপ নেই বললেই চলে। তার উপরে বিরোধী দলের লোকজনের উপরে হামলা চালাতে গিয়ে প্রকারান্তরে ধর্মঘটকেই ‘সফল’ করিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে শাসক দলের নেতৃত্বের একাংশের আক্ষেপ! প্রকাশ্যে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করেছেন, ধর্মঘটকে প্রত্যাখ্যান করেছেন রাজ্যের মানুষ। শাসক দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বন্ধ প্রত্যাখ্যান করেছেন। কলকারখানা, অফিস সব জায়গায় হাজিরা ছিল। পরীক্ষা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা একশো শতাংশই উপস্থিত হয়ে তার যোগ্য জবাব দিয়েছেন। কর্মনাশা বন্ধকে প্রত্যাখ্যান করে মানুষ বুঝিয়েছেন, তাঁরা আরও কাজ চান।’’ বিরোধীদের উপরে হামলার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তাঁর দাবি, ‘‘বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু ঘটেছে। নিজেরাই এ সব করছে! ওদের না আছে নখ, না আছে দন্ত! না আছে জনপ্রিয়তা। কচ্ছপকে উল্টে দিলে যেমন হাত-পা ছোড়ে, তেমন অবস্থা হয়েছে ওদের।’’ আর পুলিশের ভূমিকা? এই প্রশ্নের জবাবে পার্থবাবু বলেন, ‘‘প্রশাসনের কাজ প্রশাসন করেছে। পুলিশ প্রশাসনের মধ্যেই পড়ে। শান্ত ও সংযত ভাবে সব দিক দেখেছে বলে প্রশাসনকে ধন্যবাদ।’’
পুরভোটে অবাধ ভোট-লুঠ ও সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাজ্যে বামফ্রন্টের ডাকা ১২ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘট। একই সঙ্গে চলছে সিটু, আইএনটিইউসি, এইচএমএসের মতো কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে দেশ জুড়ে ২৪ ঘণ্টার পরিবহণ ধর্মঘট। এ রাজ্যের ক্ষেত্রে অবশ্য পুরভোটের প্রসঙ্গ জুড়ে শ্রমিক সংগঠনগুলিও সাধারণ ধর্মঘটই করছে। ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে এসইউসি, সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন, পিডিএসের মতো ছোট বাম দলগুলি। আবার একই দিনে একই বিষয়ে ১০ ঘণ্টার বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। ধর্মঘট বিরোধিতার নামে শাসক দলের তাণ্ডবের প্রতিবাদে দুপুরেই কলকাতার রাস্তায় নেমেছেন বাম ও বিজেপি নেতৃত্ব।
বামফ্রন্টের তরফে মৌলালির মোড় থেকে মল্লিকবাজার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মিছিল করেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমান বসু, মনোজ ভট্টাচার্য, হাফিজ আলম সৈরানিরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবু বলেন, ‘‘সরকার, প্রশাসন ও শাসক দলের যৌথ আক্রমণ মোকাবিলা করেই পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ধর্মঘটে সাড়া দিয়েছেন। তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই ঘটনা বৃহত্তর লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করল।’’ বহরমপুর থেকে দেগঙ্গা, জামুড়িয়া থেকে সিউড়ি, পুলিশের সামনেই যে ভাবে শাসক দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের মারধর করার অভিযোগ উঠেছে, তার প্রেক্ষিতেই বামেদের মিছিল থেকে স্লোগান তোলা হয়েছে— ‘পুলিশ তুমি উর্দি ছাড়ো, তৃণমূলের ঝান্ডা ধরো’! বাম নেতৃত্বের অভিযোগ, জলপাইগুড়ি, কৃষ্ণনগর, বহরমপুর, আসানসোল, জামুরিয়া, কলকাতার যাদবপুরে তৃণমূলের সমর্থকরা সিপিএমের উপরে হামলা চালায়। কিন্তু পুলিশ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে বাম নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করেছে! ধর্মঘট ভাঙতে শাসক দলের দাদাগিরির কড়া সমালোচনা করেছেন এসইউসি, পিডিএস, লিবারেশন নেতৃত্বও।
ধর্মঘট ‘সর্বাত্মক’ হয়েছে দাবি করে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর কটাক্ষ, ‘‘এই সাফল্যের পিছনে রাজ্যের স্বৈরাচারী সরকারের ভূমিকা আছে। মানুষ গণতন্ত্র হত্যার প্রতিবাদে, নিজের ভোট নিজে না দিতে পারার প্রতিবাদে, তৃণমূলের ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে।’’ ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলার আত্মহত্যা করেছিলেন, এই তথ্য দিয়ে বিমানবাবুর মন্তব্য, ‘‘২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল তৃণমূল সরকারও আত্মহত্যার কাজ করল! ধর্মঘট ভাঙতে পুলিশকে দিয়ে প্রচার করিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী ভেবেছিলেন, পুলিশের ভয়ে মানুষ দোকানপাট খুলবে। কিন্তু ফল হয়েছে তার উল্টো।’’ সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তীও বলেছেন, ‘‘রাজ্য সরকারের এখনই সতর্ক হওয়া উচিত। জোর করে ধর্মঘট করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।’’
রাহুল সিংহ, মীনা দেবী পুরোহিত, রীতেশ তিওয়ারিদের নিয়ে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় মিছিল হয় দলের রাজ্য দফতর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবুরও অভিযোগ, ‘‘পুলিশ পুরোপুরি তৃণমূলের কর্মী বাহিনীর মতো কাজ করছে! শুধু তৃণমূলের ঝান্ডা ধরে মিছিলে যোগ দেওয়াটা ওদের বাকি আছে!’’ তাঁর যুক্তি, ধর্মঘটকারীরা কোথাও হাঙ্গামা করেনি। সরকার বাস-ট্রেন চালিয়েছে। তা সত্ত্বেও মানুষ রাস্তায় বেরোননি গণতন্ত্রকে রক্ষা করবেন বলেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy