শিলিগুড়ির বিধান মার্কেটে ভিক্ষুকদের জটলা। খুচরো পেতে এখন ভরসা তাঁরাই। ছবি: সন্দীপ পাল।
অন্য দিন তাঁদের দিকে কেউ ফিরেও তাকান না। ‘‘কিছু টাকা দিন, বাবু’’, এই আবেদনের প্রত্যুত্তরে জোটে অবজ্ঞা।
ছবিটা আমূল বদলে গিয়েছে এখন।
যে চেহারাগুলো দ্রুত চলে যেত পাশ কাটিয়ে, তাঁরাই অনেকে মধুমাখা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসছেন। সাহায্য চেয়ে বলছেন, ‘‘নোটটা একটু ভাঙিয়ে দেবে দিদি?’’
বুড়ো আঙ্গুল আর তর্জনিতে ধরা পাঁচশো টাকা এগিয়ে আসার আগেই অবশ্য ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেন বৃদ্ধা। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে দিলেন, ‘‘অন্যদিন তো পাঁচ টাকাও দেন না। যান, চলে যান।’’ কপালে রসকলি করা প্রৌঢ় আবার একজনকে পরামর্শ দিলেন, ‘‘আমাকে এক মুঠো চাল দিন। নোটগুলো ব্যাঙ্কে রাখুন।’’
শনিবারের পড়ন্ত দুপুরে শিলিগুড়ির বিধান মার্কেটের রাস্তার পাশে পড়া একফালি ছায়ায় বসে ওঁদের গল্প চলছিল। কেউ মাটিগাড়ার বাসিন্দা, কারও ঘর নিউ জলপাইগুড়িতে। সকলেই বছর দশেক শিলিগুড়িতে ভিক্ষে করতে আসেন। সে সুবাদে নিজেদের মধ্যে পরিচয়। দিনভর কাজের পরে বরাবরই বিধান মার্কেটের পাশে এই রাস্তায় বসে গল্পগাছা করেন তাঁরা। পুরোনো পাঁচশো এবং এক হাজার টাকার নোট বাতিল হওয়ার পরে ওদের গল্পের বিষয় বদলে গিয়েছে। ব্যবসায়ী হোক বা গৃহস্থ, ওঁদের সামনে দেখলেই যাঁরা নাকি ভুরু কুঁচকে চলে যেতেন, তাঁরাই নাকি আদর করে ডাকছেন! আবদার একটাই, ‘‘নোটটা ভাঙিয়ে দাও।’’ কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকায় জনগণ নোটের চোট পেতেই রাতারাতি কদর বেড়ে গিয়েছে ভিক্ষুকদের।
দুপুরের আড্ডায় চিড়ে-মুড়ি খেতে খেতে মাটিগাড়ার পতিরামজোতের বাসিন্দা কল্পনা মোহন্ত উত্তেজিত হয়ে বলছিলেন চার্চ রোডের একটি দোকানে গেলে কী ভাবে ভিক্ষের সঙ্গে শুনিয়ে দেওয়া হতো, ‘একশো দিনের কাজ কর’, ‘ভিক্ষে করে তো অনেক আয়’ এমন নানা কটাক্ষ। তবে শনিবার সকালে সেখানেই উলটপুরাণ। ‘‘মাসি বলে ডাকল জানেন,’’ কল্পনাদেবীর মুখজুড়ে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। বললেন, ‘‘বলে কী, মাসি ৫০০ টাকা রাখো। তোমার যত ইচ্ছে রাখ বাকিটা ফেরত দাও।’’ কল্পনাদেবী অবশ্য রাজি হননি। ঝাঁঝিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘এতদিন লাঠিঝাঁটা দেখাতো, এখন নিজেরা ঠেকে দরদ দেখাচ্ছে। বয়েই গিয়েছে অমন ভিক্ষে নিতে!’’
মাটিগাড়ার বালাসন কলোনিতে থাকেন সুরেন রায়। প্রতিদিন পুজো-আচ্চা করেন। গত তিনদিন খুচরোর আবদার সামলাতে হচ্ছে পঞ্চাশোর্ধ প্রৌঢ়কে। বললেন, ‘‘লোকজন বাড়ি পর্যন্ত চলে আসছে। কেউ বলছে হাজার টাকার নোট ভাঙিয়ে দাও, কেউ বা পাঁচশো টাকার নোট গছাতে চাইছে। কেউ আবার বলছে টাকা রেখে দিতে, এখন না পরে নেবে।’’
বেশ কয়েকজনকে অবশ্য টাকা ভাঙিয়ে দিয়েছেন গৌরী সরকার। শুঁটকি গুদাম এলাকা থেকে এসে দু’দশক ধরে শিলিগুড়িতে ভিক্ষে করছেন। তিনি বললেন, ‘‘ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। বাড়িতে ঘটে, চালের বালতিতে, প্লাস্টিক মুড়ে টাকা রাখতাম। তা দিয়েই দু’তিনজনকে খুচরো দিয়েছি।’’বাজারে এমন অনেকের খোঁজ মিলছে যারা কমিশন নিয়ে নোট ভাঙাচ্ছেন। তবে গৌরীদেবী নেননি। বললেন, ‘‘ভাঙানির জন্য অনেকে ৫০ টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি নিইনি। যে দু’টাকা দিত তার থেকে দু’টাকা, যে ৫ টাকা দিত তার থেকে ৫ টাকাই কেটে খুচরো দিয়েছি।’’
কিন্তু পাঁচশো হাজারের নোট তাঁরা ভাঙাচ্ছেন কী করে?
গৌরীদেবী জানান, ভিক্ষে করে পাওয়া খুচরো মাসে একবার তাঁর এলাকার ব্যাঙ্কের টাকা সংগ্রহক এজেন্টকে তুলে দেন। তিনিই সেগুলিকে একশো অথবা বড় নোট করে ফেরত দিয়ে দেন। তিনি যাঁদের খুচরো দিয়ে ৫০০ টাকার নোট নিয়েছেন সেই নোটও তাঁর এলাকার এজেন্টকে দেবেন। তাঁর কথায়, ‘‘এজেন্ট পুরনো পাঁচশোর পরিবর্তে নতুন পাঁচশো জোগাড় করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তাতে কিছু সময় লাগবে। তা লাগুক। টাকা তো আমারই থাকবে।’’
মাঝখানে প্রাপ্তি শুধু উপেক্ষা থেকে আর্তির বদলটুকুই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy