Advertisement
E-Paper

অ্যাকাউন্ট ধার দিয়েই টাকা উঠল মেয়ের বিয়ের

সামনে সরকারি নিয়মের জগদ্দল পাথর। কিন্তু তাতেও মুশকিল আসান হয়ে যায়, যদি থাকে সদিচ্ছা। ঠিক যেমন হয়েছে ছবি পাত্রের ক্ষেত্রে। নোট বাতিলের জাঁতাকলে পড়া সত্ত্বেও সোমবার তাঁর মেয়ের বিয়ে আটকায়নি। কারণ ছবিদেবী পাশে পেয়েছিলেন পঞ্চায়তে সদস্য এবং পড়শিদের।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৮
পাশে আছি। কনের সঙ্গে পঞ্চায়েত সদস্য তাপস মাইতি। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

পাশে আছি। কনের সঙ্গে পঞ্চায়েত সদস্য তাপস মাইতি। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

সামনে সরকারি নিয়মের জগদ্দল পাথর। কিন্তু তাতেও মুশকিল আসান হয়ে যায়, যদি থাকে সদিচ্ছা। ঠিক যেমন হয়েছে ছবি পাত্রের ক্ষেত্রে। নোট বাতিলের জাঁতাকলে পড়া সত্ত্বেও সোমবার তাঁর মেয়ের বিয়ে আটকায়নি। কারণ ছবিদেবী পাশে পেয়েছিলেন পঞ্চায়তে সদস্য এবং পড়শিদের।

হাওড়ার জগদীশপুরে ইউকো ব্যাঙ্কের শাখায় স্বামীহারা ছবি দেবীর অ্যাকাউন্ট। দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর ক্ষতিপূরণ বাবদ পাওয়া ১ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা রাখা ছিল ওই ব্যাঙ্কেই। এ দিকে বিয়ের মরসুমে এক লপ্তে আড়াই লক্ষ টাকা তোলায় ছাড় দিয়েছে সরকার। ছবি দেবীর দরকার ছিল লাখখানেকের কাছাকাছি। ভেবেছিলেন, অ্যাকাউন্ট থেকে তুলবেন। কিন্তু শনিবার কয়েক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর ব্যাঙ্কে ঢুকে তিনি শোনেন, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক বললেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা যতক্ষণ না পৌঁছচ্ছে, বিয়েবাড়ি বলে টাকা তোলার সর্বোচ্চ সীমা শিথিল করা হবে না।

মাথায় যেন বাজ পড়ে অসহায় বিধবার। কিন্তু ব্যাঙ্কের ওই এক কথা, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নির্দেশ না দিলে কিছু করার নেই। মাঝখানে গোটা রবিবার। গোটা দিন অনিশ্চয়তা। ছবি দেবী ধরেই নিয়েছিলেন, মেয়ে দোলার বিয়ে অন্তত সোমবার তিনি দিতে পারছেন না। অথচ এ দিন বিকেল থেকে জগদীশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের দেবীরপাড়া ১ নম্বর তল্লাটে তাঁর টালির চালের ঘর ও প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। চার দিকে হইহই, হাসি, আনন্দ। রবিবার রাত পর্যন্ত যে ঘরে জমাট বেঁধেছিল অনিশ্চয়তার কালো মেঘ, সেখানে এমন মসৃণ ভাবে সব কিছু হল কী করে?

এমন নয় যে, ছবি পাত্রকে কেউ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। ছবি তাঁর ব্যাঙ্ক থেকেই টাকা পেয়েছেন। টাকা পাওয়ার পিছনে আছে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য তাপস মাইতি এবং চার প্রতিবেশীর সহযোগিতা।

কী রকম? কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক আনুষ্ঠানিক ভাবে জানালেও কেন ওই মহিলা তাঁর মেয়ের বিয়ের কার্ড-সহ অন্যান্য প্রমাণ দেখিয়ে হকের টাকা তুলতে পারবেন না— এই প্রশ্নই তাপসবাবু লিখে পাঠিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জন অভিযোগ ও প্রশাসনিক সংস্কার বিভাগের পোর্টালে। সেটা শনিবার বিকেল।

যদিও পঞ্চায়েত প্রধান গোবিন্দ হাজরা, বালি-জগাছা পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ তাপস আইন-সহ কয়েক জন বাসিন্দা আশ্বস্ত করেছিলেন, টাকার জন্য বিয়ে আটকাবে না। গোবিন্দবাবু কেটারার ও তাপসবাবু ডেকরেটারের খরচের দায়িত্ব নেন। কিন্তু নিজের অ্যাকাউন্টে যেখানে লক্ষাধিক টাকা পড়ে, সেখানে অন্যদের থেকে আর্থিক সাহায্য নিতে অস্বস্তি হচ্ছিল ছবি দেবীর। আর তাপস মাইতিও পণ করেছিলেন, এর শেষ দেখে ছাড়বেন। তিনিই নেট ঘেঁটে ওই পোর্টালের হদিস জোগাড় করে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাতেই পথ বেরোল।

এ দিন সকালে তাপসবাবুর মোবাইলে কলকাতায় ইউকো ব্যাঙ্কের প্রধান শাখার জন পরিষেবা বিভাগ থেকে একটি ফোন আসে। তাপসবাবু বলেন, ‘‘ওঁরা আমার থেকে পুরো বিষয়টি আবার শোনার পরে জানান, প্রধান শাখা থেকে জগদীশপুর শাখায় এ বিষয়ে একটি মে‌ল পাঠানো হয়েছে। তাই, আমরা যেন সেখানে গিয়ে দেখা করি।’’

এর পর ওই ব্যাঙ্কের জগদীশপুর শাখায় গেলে কর্তৃপক্ষ তাঁদের জানিয়ে দেন, নিয়ম তাঁরা শিথিল করছেন না। তবে ছবি দেবীর অ্যাকাউন্টের টাকা তাঁরা ছবি দেবীর আত্মীয় কিংবা ঘনিষ্ঠ কোনও চার জনের অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেবেন। তাঁরা এলে ২৪ হাজার করে মোট ৯৬ হাজার টাকা তুলে নিয়ে যেতে পারবেন। ব্যাঙ্ক এই প্রস্তাব দিতেই চার প্রতিবেশী এগিয়ে আসেন। তাঁদের ওই ব্যাঙ্কেই অ্যাকাউন্ট রয়েছে। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ সমস্ত টাকা তুলে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে আসেন ছবিদেবী। ইউকো ব্যাঙ্কের জগদীশপুর শাখার ম্যানেজার পি পানিগ্রাহী বলেন, ‘‘রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা পাইনি। আমাদের প্রধান শাখা যে নির্দেশ পাঠিয়েছে, সেই মতো কাজ করেছি।’’

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা কবে আসবে? আরবিআইয়ের একটি সূত্রের বক্তব্য, এ ক্ষেত্রে নির্দেশিকা আলাদা করে কোনও ব্যাঙ্কে পাঠানো হবে না। বিয়েবাড়ির জন্য টাকার সর্বোচ্চ সীমা শিথিল করার গাইডলাইন ওয়েবসাইটেই আছে। যদিও বহু ব্যাঙ্কই পাল্টা দাবি করেছে, এমন কোনও গাইডলাইন তারা খুঁজে পাচ্ছে না।

ছবি দেবী অবশ্য এখন আর এ সব নিয়ে ভাবছেন না। এ দিন সন্ধ্যায় জামাই বরণের আয়োজনের ফাঁকে বললেন, ‘‘পঞ্চায়েতের দাদারা না থাকলে ভেসে যেতাম।’’ বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল তাঁর। বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত তাপসবাবুও বললেন, ‘‘ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। সে পথেই এক বোনের মুখে হাসি ফোটালাম।’’

একই ভাবে দমদমের প্রমোদনগরেও বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তুলতে সাহায্য করেছেন দক্ষিণ দমদম পুরসভার কাউন্সিলর। স্থানীয় বাসিন্দা হরেকৃষ্ণ বিশ্বাসের এ দিনই বিয়ে ছিল। সকালে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গড়ুই শাখায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পরনে ধুতি, একটু আগেই গায়ে-হলুদ হয়েছে। তাঁর ৩৫ হাজার টাকা তোলার দরকার ছিল। যথারীতি বিয়ের কার্ড দেখিয়েও প্রথমে সুবিধে হচ্ছিল না। এর পরেই স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর প্রদীপ মজুমদার আসরে নামেন। ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। তখন উপায় বাতলান ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। সেই মতো হরেকৃষ্ণ তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর এক বন্ধুর দু’টি অ্যাকাউন্টে অনলাইন ট্রান্সফারে ৩৫ হাজার টাকা পাঠান। সাহায্য করে ব্যাঙ্কই। তার পর ওই বন্ধু তাঁর দু’টি অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৫ হাজার টাকা তুলে হরেকৃষ্ণকে দেন। পাত্রের মুখে হাসি ফোটে।

(সহ প্রতিবেদন: প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়)

bank people marriage ceremony
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy