যাদের মধ্যে সমন্বয় না-হলেই নয়, তারাই এখন যুযুধান। এক পক্ষে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম। অন্য দিকে রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক স্বাস্থ্য ভবন। স্বাস্থ্য পরিষেবার অব্যবস্থা নিয়ে দু’পক্ষে চলছে নিরন্তর টানাপড়েন। কেন টানাপড়েন? সেটা কিন্তু অনেকেরই বোধগম্য হচ্ছে না।
কিছু দিন আগেই স্বাস্থ্য ভবনকে অন্ধকারে রেখে এসএসকেএমে শয্যা বরাদ্দের বিষয়ে নির্দেশ জারি নিয়ে গোলমাল হয়েছিল বিস্তর। এ বার ওই হাসপাতালের বেহাল পরিকাঠামো ও পরিষেবা নিয়ে কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি পাঠানোয় তোলপাড় শুরু হয়ে গিয়েছে। এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ নিজেরা হাসপাতালের পরিকাঠামো গড়তে ব্যর্থ বলে পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা।
এসএসকেএমে অকেজো ‘ইমার্জেন্সি রিস্যাসিটেশন ইউনিট’ বা ইআরইউ চালু করা, ওয়ার্ডে শয্যা এবং ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা বাড়ানোর মতো কিছু অনুরোধ জানিয়ে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তার দফতরে চিঠি পাঠিয়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের তোপের মুখে পড়েছেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। ইআরইউ হল ইমার্জেন্সি বা জরুরি বিভাগ সংলগ্ন পাঁচ শয্যার বিশেষ ওয়ার্ড। গুরুতর অসুস্থ বা আহত রোগী জরুরি বিভাগে এলে তাঁর শারীরিক পরিস্থিতি তৎক্ষণাৎ স্থিতিশীল করার জন্য ওই ইউনিট চালু হয় বছর চারেক আগে। তার জন্য মনিটর, অক্সিজেন, অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি এবং আলাদা চিকিৎসকের বন্দোবস্তও হয়েছিল। কিন্তু গত ২৩ জুন স্বাস্থ্য ভবনে পাঠানো চিঠিতে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষই স্বীকার করে নিয়েছেন, এই অতি জরুরি ইউনিটটি এখন পুরোপুরি বন্ধ।
ওই চিঠির তলায় সই রয়েছে পিজি-র অধ্যক্ষা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সেই সময় সুপারের পদে থাকা মানস সরকারের। ২৪ জুন স্বাস্থ্য ভবনে ওই চিঠি পৌঁছতেই সেখানকার কর্তারা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। যে-সমস্যা হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিতে আলোচনা করে বা বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেখানকার কর্তৃপক্ষেরই সমাধান করা উচিত, তার জন্য স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে তাঁরা প্রতিকার চাইবেন কেন, প্রশ্ন তুলছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ। তাঁদের মনে হয়েছে, এটি এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষের অপদার্থতার প্রমাণ এবং দায়িত্ব এড়ানোর ফিকির।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, চিঠি পেয়েই স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তার দফতর থেকে এসএসকেএমের অধ্যক্ষাকে ফোন করে কার্যত ভর্ৎসনা করা হয়। বলে দেওয়া হয়, নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই মেটাতে হবে। স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘ইমার্জেন্সিতে লোক না-থাকলে, ইআরইউ না-চললে আমরা কী করব? এটা তো অধ্যক্ষের দেখার কথা। তিনি করছেনটা কী?’’ পিজি-কর্তৃপক্ষের এই ধরনের কাজকর্মের পিছনে রাজনীতির হাত দেখছেন সুশান্তবাবু। তাঁর অভিযোগ, আসলে ডিএসও-র ছেলেরা যেমন যেমন বলছে, পিজি-কর্তৃপক্ষ সেই ভাবেই চলছেন! ওদের ভয়ে কোনও প্রতিবাদ করছেন না। ওরা চিঠি লিখতে বলেছে বলেই স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এতে ভুল কিছু দেখছেন না ডিএসও-সমর্থক জুনিয়র ডাক্তারেরা। ওই সংগঠনের এসএসকেএম শাখার সম্পাদক কবিউল হক জানান, ইআরইউ-এ উন্নত মানের যন্ত্রপাতি আছে। কিন্তু লোক নেই। ফলে ইউনিট অচল। ‘‘লোকবল কম। ট্রলি নেই। গুরুতর অসুস্থকে ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে যেতেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। রোগীর সঙ্গীদের রাগ এসে পড়ে জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে। আগে অনেক বার ইআরইউ সচল করতে বলেও লাভ হয়নি। আসলে পরিকাঠামোর গলদগুলো কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছেন বলে স্বাস্থ্যকর্তাদের রাগ হয়েছে,’’ বললেন ওই ছাত্রনেতা।
শুধু ছাত্রনেতা কবিউল নয়। অনেকেই মনে করছেন, কর্তারা খেপেছেন স্বাস্থ্য পরিষেবায় ফাঁকফোকর প্রকট হয়ে যাওয়ায়। এসএসকেএম-কর্তৃপক্ষ এই চিঠি লিখে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি রিস্যাসিটেশন ইউনিট যে অকেজো, সেই তথ্যে প্রকাশ্যে সিলমোহর দিয়ে ফেলেছেন। সত্যি কথা এ ভাবে ফাঁস হয়ে যাওয়াতেই স্বাস্থ্যকর্তাদের রাগ হয়েছে। পিজি-র অধ্যক্ষা মঞ্জুদেবী অবশ্য বলেছেন, ‘‘আপনাদের যা ইচ্ছে লিখুন। এই পরিস্থিতিতে আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’ কেন চিঠি লেখা হল? প্রশ্ন শুনে ফোন নামিয়ে রাখেন তখনকার সুপার মানসবাবুও।
পিজি-র অন্দরের খবর, গুরুতর আহত একটি শিশুর চিকিৎসা না-করে জরুরি বিভাগে দীর্ঘ ক্ষণ ফেলে রাখার অভিযোগে ২২ জুন রাতে গোলমাল হয়। নিরাপত্তার দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি শুরু করেন। পরের দিন তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন কর্তৃপক্ষ। আন্দোলনকারীরা জরুরি বিভাগে পরিকাঠামোর উন্নতি এবং ইআরইউ সচল করার দাবি জানান। কার্যত তাঁদের চাপেই কর্তৃপক্ষ চিঠি লেখেন স্বাস্থ্য ভবনে।
কর্তৃপক্ষ এমন চিঠি লিখে পাঠানোয় ক্ষুব্ধ এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ও মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তাঁর বক্তব্য, ইআরইউ চালু করা বা ইমার্জেন্সিকে আরও উন্নত করতে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষেরই সক্রিয় হওয়া উচিত। অথচ নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে তাঁরা স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি পাঠাতেই বেশি সক্রিয়! ‘‘দেখা যাচ্ছে, এই কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের কাজকর্ম কিছুই সামলাতে পারছেন না। পিজি-কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য ভবনে চিঠি লিখে ফেললেন! অথচ হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির ২৫ জুনের বৈঠকে এ ব্যাপারে কেউ কিছু বললেন না। কেন,’’ প্রশ্ন ফিরহাদের।
মন্ত্রী ফিরহাদের প্রশ্নের পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। আরোগ্য নিকেতনে রোগী-কল্যাণই যদি প্রথম ও শেষ কথা হয়, পিজি-র মতো হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য ভবনের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেদের মধ্যে কাজিয়ায় মেতেছে কেন? বিশেষ ইউনিটটিকে চালু করাই যদি লক্ষ্য হয়, পারস্পরিক সমন্বয়ে তা করা যেতে পারে না কি?
কর্তারা সব নিরুত্তর।