Advertisement
০৫ মে ২০২৪

তাঁবুতেই বিশ্রাম নেন দেবতারা

২০০৮-এ মহীশূরের বিশ্ববন্দিত দশেরা দেখার পরেই মনে হয়েছিল এ বার কুলুর দশেরাটাও দেখতে হবে। পরের বছর দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাবণ পোড়ানো দেখেছিলাম বটে কিন্তু কুলুর জন্য আকুলিবিকুলিটা রয়েই গিয়েছিল মনের মধ্যে।

ক্যাসল থেকে নাগ্গরের শোভা।

ক্যাসল থেকে নাগ্গরের শোভা।

দেবোত্তম চক্রবর্তী
দণ্ডপাণিতলা, নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৮
Share: Save:

২০০৮-এ মহীশূরের বিশ্ববন্দিত দশেরা দেখার পরেই মনে হয়েছিল এ বার কুলুর দশেরাটাও দেখতে হবে। পরের বছর দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাবণ পোড়ানো দেখেছিলাম বটে কিন্তু কুলুর জন্য আকুলিবিকুলিটা রয়েই গিয়েছিল মনের মধ্যে।

অবশেষে এ বছরের ষষ্ঠীর রাতে বর্ধমান থেকে কালকা মেলে চেপে বসলাম। দু’রাত ট্রেনে কাটিয়ে কালকা পৌঁছলাম অষ্টমীর দিন ভোর পাঁচটায়। পুজোর ভিড়ে শিবালিক এক্সপ্রেসের টিকিট পাইনি। তাই আগে থেকে ঠিক করা বলবন্ত সিংহের গাড়িতে সওয়ার হলাম আমরা ছ’জন। শিমলার হোটেলে পৌঁছে স্নান-খাওয়া-বিশ্রাম সেরে বেরিয়ে পড়লাম ইতিহাস বিজড়িত বিখ্যাত ভাইসরিগ্যাল লজ (বর্তমানে ‘ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ’ নামে পরিচিত) দেখতে। তার পর বিকেলে পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম বাঙালির অবশ্য গন্তব্য শিমলা কালীবাড়ি। সন্ধ্যারতি দেখে ফেরার পথে লক্কড়বাজারে কাঠের তৈরি অসামান্য কিছু হস্তসামগ্রী কিনে হোটেলে ফিরলাম রাত আটটায়।

পরের দিন দেখতে গেলাম ৪৫ কিলোমিটার দূরের চেইল, যা আমির খানের ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর দৌলতে ইদানীং বিখ্যাত। সেখানে পাতিয়ালার মহারাজ ভূপিন্দর সিংহের প্রাসাদ ছাড়াও দেখলাম বিশ্বের উচ্চতম ক্রিকেট মাঠ। চেইল থেকে শিমলা ফেরার পথে কুফরির চিনিবাংলোয় মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর বরফঢাকা কুফরি না দেখতে পেয়ে হতাশ হলাম যদিও!

বিজয়া দশমীর দিন রওনা দিলাম কুলুর উদ্দেশে। কুলু আসার পনেরো কিলোমিটার আগে বাজৌরায় দেখলাম নিরিবিলি পরিবেশে বিশ্বেশ্বর শিবমন্দির। কুলুতে ঢুকতেই দেখি ঢালপুর ময়দান জুড়ে উৎসবের পরিবেশ। ওই মাঠে মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করছেন কুলুর প্রধান দেবতা রঘুনাথজি। আর হিমাচলের নানা গহীন প্রান্ত থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কুলুতে নেমে এসেছেন নানা দেবদেবী। প্রতিটি দেবমূর্তি রুপোর, তাঁদের সর্বাঙ্গ ঢাকা পড়েছে ফুল আর টাকার মালায়। সারা মেলাপ্রাঙ্গণ ছোট ছোট তাঁবুতে ভর্তি। সেই তাঁবুতেই দেবতাদের রাতে বিশ্রামের বন্দোবস্ত। যে এলাকার দেবতা, সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দারাই অবতীর্ন হয়েছেন তাঁদের উপাস্য দেবতার পাহারাদারের ভূমিকায়। নানা পাহাড়ি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে মনুষ্যবাহিত ডুলিতে দেবদেবীরা পরিক্রমায় বেরিয়েছেন— মাঝে মাঝে সে দৃশ্যও চোখে পড়েছে। মূলত স্থানীয় লোকজনের ভিড়, তবে উৎসাহী পর্যটকও দেখা যাচ্ছে ইতিউতি। অদ্ভুত শান্ত পরিবেশে এ হেন একটা উৎসবে হাজির হতে পেরে দারুণ লাগছিল।

কী করে যাবেন?

বিমানে চণ্ডীগড় পৌঁছে গাড়িতে শিমলা। ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে কালকা মেলে
কমবেশি ৩৩ ঘন্টায় কালকা । সেখান থেকে টয়ট্রেন বা গাড়িতে চেপে শিমলা।

কখন যাবেন?

বর্ষা এড়িয়ে বছরের যে কোনও সময়। হিমাচলের শ্বেতশুভ্র শোভা দেখতে শীতেও যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন?

হিমাচলের শিমলা, কুলু কিংবা মানালিতে থাকার অজস্র জায়গা। নানা দামের ও মানের বেসরকারি হোটেলের
পাশাপাশি প্রতিটি স্থানেই আছে হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজমের নিজস্ব হোটেলও। মাণ্ডী এবং চণ্ডীগড়েও প্রচুর হোটেল।

পরের দিন ৪৫ কিলোমিটার দূরের মণিকরণের উষ্ণ প্রস্রবণ দেখে (শুধু অনিন্দ্যসুন্দর পথশোভা, বিশেষত মণিকরণের পাঁচ কিলোমিটার আগে কাসোল-এর সৌন্দর্য দেখার জন্যই এ রাস্তায় আসা যায় বারবার) দ্বাদশীর দিন আমরা চললাম নাগ্গরের পথে। কুলু থেকে পাতলিখুল এসে ডান দিকের রাস্তা বেঁকে গিয়েছে নাগ্গরের দিকে আর সোজা রাস্তায় বিপাশাকে ডান পাশে রেখে মানালি।

আমাদের ড্রাইভার প্রথমে গাড়ি থামালেন বিখ্যাত নাগ্গর ক্যাসলের সামনে। পুরো বাড়িটার স্থাপত্যের অভিনবত্বে হতবাক হয়ে যেতে হয়। সারা বাড়ি জুড়ে দেবদারু কাঠের অপূর্ব কারুকাজ, স্লেটপাথরের ছাদ আর খোয়া পাথরে গাঁথা দেওয়াল — সত্যিই বিস্ময়কর। প্রাসাদ থেকে নাগ্গরের অস্বাভাবিক সুন্দর দৃশ্য মন কেড়ে নেয় সহজেই।

এ চত্বরেই আছে জগতি পাত নামের ছোট্ট অথচ সুন্দর এক মন্দির। ক্যাসল ছেড়ে এ বার গাড়ি এগিয়ে চলল ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের দিকে। দেবদারু নির্মিত প্যাগোডাধর্মী এই মন্দিরের স্থাপত্যেও নিজস্বতা বর্তমান। পরের গন্তব্য রোয়েরিখ আর্ট গ্যালারি। রাশিয়ার বিখ্যাত চিত্রকর প্রকৃতিপ্রেমিক নিকোলাস রোয়েরিখ নাগ্গরের অসীম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানেই তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলো কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। এখানকার মিউজিয়ামে তাঁর ও তাঁর পুত্র স্বেতোস্লাভ রোয়েরিখের আঁকা ছবি এবং আলোকচিত্র দেখবার মতো। এর পর চললাম আরও খানিকটা উঁচুতে উরসবতী আর্ট সেন্টারে লোকশিল্পের সংগ্রহ দেখতে।

নাগ্গর দেখা শেষ করে মাত্র ১১ কিমি পাড়ি দিয়ে প্রাচীন কুলুর রাজধানী জগৎসুখে গৌরীশঙ্কর মন্দির ও সন্ধ্যা গায়ত্রী মন্দির দেখে বিকেলে মানালি পৌঁছলাম। তার পর মানালির হিড়িম্বা মন্দির, রোটাং পাস এবং মাণ্ডীর কাছে রিওয়ালসর হ্রদ দর্শন করে চণ্ডীগড়ে নেমে আসলাম।

রবিবার রক গার্ডেন আর পিঞ্জোর উদ্যান দেখিয়ে বলবন্ত যখন ‘ফির মিলেঙ্গে’ বলে কালকা স্টেশনে ছেড়ে দিচ্ছেন আমাদের, তখন পূর্ণিমার অপার্থিব জ্যোৎস্নায় আলোকিত চারপাশ। হঠাৎই মনে পড়ল আজ কোজাগরী পূর্ণিমা।

ছবি: লেখক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kullu Tourist Spot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE