ব্রাহ্মণবাড় অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু তিনি এলেন না।
দিন সাতেক আগে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল গ্রামটা। গিয়েছিল ১২টা প্রাণ। যাঁদের অধিকাংশই আবার নাবালক।
বিস্ফোরণের একদিন পরে ঘটনাস্থলে এসে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা মুখ্যমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, ‘হিম্মত থাকলে মুখ্যমন্ত্রী এখানে আসুন’ বলে। কিন্তু সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাতেই হতাশ স্থানীয় বাসিন্দারা।
মঙ্গলবার সন্ধ্যাতেই জেলায় ঢুকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার উপর সড়ক পথে ঝা়ড়গ্রামে আসায়, আশা আরও বাড়ছিল। বুধবার সকাল থেকে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল— গ্রামে আসতে পারেন তিনি। তবু শেষ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী এলেন না ব্রাহ্মণবাড়ে।
বিরোধীরা ইতিমধ্যেই বলছে, সত্য উদ্ঘাটনের ক্ষেত্রে রাজ্যে পালাবদলের আগের তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ভূমিকা ছিল, তা আমূল বদলে গিয়েছে ক্ষমতায় আসার পরে। তার উপর পিংলা বিস্ফোরণে ১২ জনকে ‘খুনে’র মামলায় প্রশাসন ও দল জড়িয়ে পড়ায় ‘সৎ সাহস’ হারিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী। তাই এখন ঘটনাস্থলে না এসেই ‘বিয়েবাড়ির বাজি’ তত্ত্বেই আটকে থাকতে চাইছেন তিনি।
৬ মে রাতে পিংলার ব্রাহ্মণবাড় গ্রামে তৃণমূল নেতা রঞ্জন মাইতির জমিতে চলা বাজি কারখানা পর পর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল। মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের, জখম আরও ৪জন। মৃতদের অধিকাংশই মুর্শিদাবাদ থেকে আসা নাবালক। ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গেই আবার তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছেন, “ওখানে বিয়েবাড়ির বাজি তৈরি হচ্ছিল।” একই সুর ধরেছেন রাজ্য পুলিশের আইজি থেকে ডিআইজি সিআইডি (পশ্চিমাঞ্চল)—সকলেই। অথচ ওই ‘বিয়ে বাড়ির বাজি’ তৈরির কারখানা থেকেই পাওয়া গিয়েছে রাশি রাশি ‘স্টোনচিপস্’। সে গুলি বোমায় ‘স্প্লিন্টার’ হিসাবেই ব্যবহার করা হত বলে ধারণা।
সে দিনের বিস্ফোরণও তেমন ইঙ্গিতই দিয়েছে। বিস্ফোরণের পর ছিন্নভিন্ন দেহ গাছের ডালে ঝুলতে দেখা গিয়েছে। ঘটনাস্থলের একশো মিটার জুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে স্থানীয় বহু মানুষের বাড়ি। তাই ঘটনায় সিআইডি তদন্তে আস্থা হারিয়ে এনআইএ তদন্তের দাবি তুলেছে বিজেপি। ক্ষতিগ্রস্ত ও মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরনের দাবি তুলেছে বামেরা। ব্রাহ্মণবাড়ে এসে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “একটা নির্বাচিত সরকার চলছে বলে মনে হচ্ছে না।” আর তার আগে ৮ মে পিংলায় এসে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, “মুখ্যমন্ত্রী আপনার সৎ সাহস থাকলে এখানে আসুন। এখানে বাজি নয়, কিছু মানুষের জীবন বাজি রাখা হয়েছিল। আপনার হিম্মত থাকলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘটনাস্থলে আসুন।”
চ্যালেঞ্জ মুখ্যমন্ত্রী গ্রহণ করবেন বলেই আশা ছিল স্থানীয় আতঙ্কিত ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাহ্মণবাড়ের মানুষের। মঙ্গলবার স্থানীয় সাধন দাস, নিতাই প্রধানরা তাই বলছিলেন, “সিপিএমের চ্যালেঞ্জ নয়, এতগুলি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, সে জন্যই তো মুখ্যমন্ত্রীর এখানে একবার আসা উচিত।”
যদিও বিমান বসু আগেই বলেছিলেনন, “মুখ্যমন্ত্রী পিংলায় আসবেন কোন মুখে? উনি তো ভাল করেই জানেন ওঁর আদরের ছোট ছোট ভাইয়েরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। যাঁর সঙ্গেই কথা বলছি, সকলেই ‘দিদি’-র বিরুদ্ধ কথা বলছে। পুরো গ্রাম তেতে রয়েছে।’’
‘তেতে থাকা’ ঘটনাস্থলের অভিজ্ঞতা এর আগেও হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী। তা সে কামদুনি হোক বা রানাঘাট। অকুস্থলে পৌঁছতেই ক্ষোভের আঁচ লেগেছে তাঁর গায়ে। মেজাজ হারিয়েছেন তিনিও। ফলে এ বার অনেকটাই সতর্ক তিনি। তাই পাশ দিয়ে ঘুরে গেলেও, পা দেননি অকুস্থলে। তবে বুধবার ঝাড়গ্রাম থেকে হেলিকপ্টারে ওঠার আগে পিংলায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়ে গিয়েছেন তিনি। বামেদের দাবি ছিল ক্ষতিপূরণের। দূর থেকেই তিনি তা পূরণ করেছেন।
কিন্তু তাতে ক্ষোভ কমছে না। ব্রাহ্মণবাড়ের বাসিন্দা সনাতন টুডু, পার্বতী হেমব্রম, রঞ্জিত প্রধানরা বুধবার বিকেলেও বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী এখানে আসবেন বলে আশা ছিল। এলে তিনি বুঝতে পারতেন বিয়েবাড়ির বাজির ছিল না কী ছিল। পিংলাকে এড়িয়ে কলকাতায় চলে গেলেন।’’