Advertisement
E-Paper

পাখি ওড়ার পরে তল্লাশি

অপরাধ নিয়ে যত না ধন্দ, তার চেয়ে বেশি রহস্য তৈরি হয়েছে তদন্ত নিয়ে। সোমবার কান্দিতে তৃণমূলের মিছিলে দিশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের কয়েক জনের উল্লাসের ১৯ ঘণ্টা পরে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ। গ্রেফতার করেছে ইমরান শেখ এবং গয়ানাথ কৈবর্ত্য নামে দুই ব্যক্তিকে। কিন্তু পুলিশি তদন্তের প্রতি পদক্ষেপ বিচিত্র প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।

শুভাশিস সৈয়দ ও কৌশিক সাহা

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৪
সব্যসাচী দাসের বাড়িতে পুলিশ। মঙ্গলবার কান্দিতে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

সব্যসাচী দাসের বাড়িতে পুলিশ। মঙ্গলবার কান্দিতে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক

অপরাধ নিয়ে যত না ধন্দ, তার চেয়ে বেশি রহস্য তৈরি হয়েছে তদন্ত নিয়ে। সোমবার কান্দিতে তৃণমূলের মিছিলে দিশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে কর্মী-সমর্থকদের কয়েক জনের উল্লাসের ১৯ ঘণ্টা পরে অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ। গ্রেফতার করেছে ইমরান শেখ এবং গয়ানাথ কৈবর্ত্য নামে দুই ব্যক্তিকে। কিন্তু পুলিশি তদন্তের প্রতি পদক্ষেপ বিচিত্র প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
প্রশ্ন ১। টিভির পর্দায় গোটা রাজ্য দেখেছে, সোমবার কারা ওয়ান শটার, ৯ এম এম পিস্তল নিয়ে তাণ্ডব করেছে পুরভবনের সামনে। প্রত্যক্ষদর্শী তৃণমূলের কর্মিসভায় মোতায়েন পুলিশও। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে সংবাদমাধ্যম সেই অপরাধীদের চিহ্নিতও করেছে। সব্যসাচী দাস, পার্থসারথি দাস, দুঃশাসন ঘোষ এবং মাধব দাস, সকলেই কান্দি পুরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তা সত্ত্বেও মঙ্গলবার সকাল ৮টায় পুলিশ ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইন-সহ একাধিক অভিযোগ করল। কেন?
প্রশ্ন ২। টিভি-র পর্দায় যাঁদের আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দেখা গিয়েছে, তাঁদের অনেকেই সোমবার রাত পর্যন্ত এলাকায় ছিলেন। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথাও বলেছেন। তাঁদের একজন, মাধব দাস, মঙ্গলবার সকাল ৮টা নাগাদ নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছিলেন, দাবি প্রতিবেশীদের। পুলিশ কিন্তু তল্লাশি চালায় বেলা দেড়টা থেকে আড়াইটের সময়, যখন চিহ্নিত চার অপরাধী আর এলাকায় নেই। তাঁদের ‘পলাতক’ বলে দাবি করছে পুলিশ। কেন আগেই তাদের আটক করা হল না?
৩। সোমবার অভিযুক্তদের কয়েক জনের হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দেওয়ার পরে মঙ্গলবার জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডল কেন দাবি করলেন, তাঁদের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক নেই?
বিরোধীদের দাবি, এর মধ্যে কোনও রহস্য নেই। তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী খোদ বলছেন, কোনও টিভি চ্যানেল তৃণমূলের মিছিলে ‘‘লোক ঢুকিয়েছে।’’ এর পর প্রকৃত দোষী যে তৃণমূলেরই সদস্য, তা জানলেও তাদের ধরতে সাহস করবে না পুলিশ। সবংয়ের কলেজে ছাত্র খুনের ঘটনার তদন্তেও এমনই দেখা গিয়েছে, বলছেন তাঁরা। গোড়ায় খুনের ঘটনায় পুলিশ টিএমসিপি-র তিন সদস্যকে ধরলেও, মুখ্যমন্ত্রী ওই খুনকে ছাত্র পরিষদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেন। তার পর থেকে ছাত্র পরিষদের সদস্যদেরই গ্রেফতার করে পুলিশ। চার্জশিট দিলে দেখা যায়, টিএমসিপি-র এক জনের নাম চার্জশিটে নেই। বাকিদের বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য ধারা দেওয়া হয়েছে।
কান্দির মিছিল কাণ্ডে অবশ্য তৃণমূল অভিযুক্তদের থেকে দূরত্ব তৈরির চেষ্টা করছে গোড়া থেকেই। সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী সোমবারই ইঙ্গিত দেন, অভিযুক্তরা কংগ্রেসের লোক। তৃণমূলের মুর্শিদাবাদ জেলা সভাপতি মান্নান হোসেন এ দিন দাবি করেন, ‘‘ধৃত দুই ব্যক্তি তৃণমূলের কেউ নয়।’’

ধৃত ইমরান শেখ ও গয়ানাথ কৈবর্ত্যকে তৃণমূল নেতারা ‘এ ভাবে ঝেড়ে ফেলায়’ ক্ষুব্ধ তাদের পরিবার। ধৃতরা কান্দির ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এলাকায় তারা তৃণমূলকর্মী বলেই পরিচিত। পুলিশের দাবি, ইমরান ও গয়ানাথ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মিছিলে ছিল। কিন্তু গয়ানাথের ভাই বৃন্দাবন কৈবর্ত্য দাবি করেন, গয়ানাথ মিছিলে থাকলেও তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। তাঁর অভিযোগ, ‘‘দাদা তৃণমূলই করত। এখন নেতারা বিপদ বুঝে তাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।’’ বৃন্দাবন নিজে অবশ্য এ দিন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। দাদার সঙ্গে চেহারার মিল থাকায় এ দিন তাঁকেই ধরে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ।

ইমরানের বাবা আল্লারাখা শেখও বলেন, ‘‘আমরা তৃণমূল করি। ছেলে মিটিং-মিছিলে যায়। পুলিশ ওকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করল। যারা আসল অপরাধী তাদের আড়াল করতেই বলির পাঁঠা করা হল আমার নাবালক ছেলেকে।’’ পুলিশ জানিয়েছে, ইমরানের বিরুদ্ধে চুরি-ডাকাতির একাধিক মামলা রয়েছে।

ঘনিষ্ঠ মহলে কান্দির একাধিক তৃণমূল নেতা মেনেছেন, ‘‘পিস্তল নিয়ে মিছিলে যাদের দেখা গিয়েছে তারা সকলেই জেলা কার্যকরী সভাপতি উজ্জ্বল মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ। কান্দি থানা মোড়ে তৃণমূলের কার্যালয়ে ওদের যাতায়াত রয়েছে। এখন দলের নেতৃত্ব অস্বীকার করলেই তো আর সব মিথ্যে হয়ে যায় না।’’

বিশেষত ভিডিও ফুটেজে দেখা গিয়েছে যে দুই ভাইকে, সেই সব্যসাচী ও পার্থসারথির বাবা সনাতন দাস এলাকায় তৃণমূল নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। পরিবারের দাবি, সনাতনবাবু ধর্ম-কর্ম নিয়েই থাকেন। বড় ছেলে সব্যসাচী আগে কলকাতায় একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে কাজ করলেও এখন বেকার। ছোট ছেলেও কোনও পেশার সঙ্গে যুক্ত নন। এলাকার বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘রোজ সকালে সনাতনবাবু বড় সাদা গাড়িতে বেরিয়ে যান। কাচ তোলা থাকে।’’ দোতলা বিরাট বাড়ি। প্রতিটি ঘর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। বাড়ির মেঝে মার্বেল থেকে উঠোনে মোজাইক করা রয়েছে। সনাতনবাবুর স্ত্রী নীলিমাদেবী জানান, তাঁর শিক্ষকতার পেনশন এবং ভক্তদের দান থেকেই সংসার চলে।

এ দিন অবশ্য বাবা কিংবা দুই ছেলের দেখা মেলেনি। সোমবার যখন তৃণমূলের ওই কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নাচানাচি করছিল তখন আশপাশেই উপস্থিত ছিলেন কান্দি থানার বহু পুলিশকর্মী। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটেছে। উপরতলার নির্দেশ না থাকায় কিছুই করতে পারিনি।’’ তাঁর আক্ষেপ, রাতেই পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করলে অভিযুক্তদের ধরা যেত। তা না করে পালানোর সুযোগ দেওয়া হল।

জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর অবশ্য ঢিলেমির অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, ভিডিও ফুটেজ দেখে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে সময় লেগেছে। আপাতত অজ্ঞাতপরিচয় কয়েক জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে। তদন্তে যাদের নাম উঠে আসবে, তারা অভিযুক্তদের তালিকায় ঢুকে যাবে, আশ্বাস দিচ্ছেন তিনি।

নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ায় মঙ্গলবার এক স্মরণ সভায় সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘যাদের হাতে অস্ত্র ছিল, তারা দুষ্কৃতী। তাদের সঙ্গে তৃণমূলের কোনও যোগ নেই। ধৃত দু’জনকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুক তাদের পিছনে কারা রয়েছে।’’

shubhashis saiyad kaushik saha pistol rally tmc pistol rally pistol incident police negligence kandi tmc pistol holder kandi pistol rally
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy