Advertisement
E-Paper

শব্দবাজি আটকাতে অভিযান আছে, সদিচ্ছা নেই

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সঙ্গে থাকুক বা না-থাকুক আজ, সোমবার থেকে শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে কলকাতা পুলিশ।

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:১৩

দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সঙ্গে থাকুক বা না-থাকুক আজ, সোমবার থেকে শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালাবে কলকাতা পুলিশ। এই অভিযান চলবে ২৮ অক্টোবর, অর্থাৎ কালীপুজোর আগের দিন পর্যন্ত।

লালবাজারের এক কর্তা রবিবার বলেন, ‘‘কেউ মামলা করলে আগে আমাদের নিয়েই টানাটানি হবে। তাই আমাদেরই রাস্তায় নামতে হচ্ছে। তবে এই অভিযানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আমাদের সঙ্গে থাকলে ভাল হতো। কারণ, ওঁরা এ সব ভাল বোঝেন!’’ পুজোর আগে ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর, কলকাতা পুলিশ নিষিদ্ধ আতসবাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু ওই অভিযানে পর্ষদের কেউ ছিলেন না। এ বারেও থাকবেন কি না, বোঝা যাচ্ছে না। অভিযানে সামিল হতে লালবাজারের পক্ষ থেকে পর্ষদকে লিখিত ভাবে অনুরোধ করা হয়েছিল। রবিবার রাত পর্যন্ত পর্ষদ জানায়নি তারা কী করবে।

কেন? প্রশ্ন করলে পর্ষদের কর্তাদের মুখে কুলুপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্তা কেবল বললেন, ‘‘আমরা নামেই স্বশাসিত সংস্থা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না হলে শব্দদূষণ ঠেকাতে আমরা কিছুই করতে পারব না।’’

একটা সময়ে কিন্তু পর্ষদ জুন-জুলাই মাসে অভিযান শুরু করে দিত। শব্দবাজির কারখানায় পুলিশকে নিয়ে যেত। পুলিশকর্তারাও মানেন, ‘‘পর্ষদ সঙ্গে থাকলে আমাদের সুবিধে হয়। কোন বাজি নিষিদ্ধ, কোনটা নয়, সেই সব খুঁটিনাটি পর্ষদের অফিসাররা ভাল বোঝেন।’’ কিন্তু সেই অভিযান এ বার পর্ষদ এক বারও করেনি। যার ফল রবিবার সন্ধ্যায় ভাল রকম টের পেয়েছেন সল্টলেকের বাসিন্দারা। চকোলেট বোমা, চেন ক্র্যাকার, দোদমা, রকেট বোমা ও শেল ফেটেছে একের পর এক। ইই ব্লকের এক বাসিন্দার কথায়, ‘‘মনে হচ্ছে, কালীপুজোর সন্ধ্যায় কী হবে, তার একটা মহড়া হয়ে গেল।’’ ওই ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বিপুল পরিমাণ শব্দবাজি ইতিমধ্যেই বাজারে ঢুকে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে গিয়েছে। তাই সোমবার থেকে কলকাতা পুলিশ যে অভিযান শুরু করবে, তাতে লাভ কতটা হবে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। পর্ষদের অন্দরে দাবি, এ বার শব্দবাজির বিরুদ্ধে পুলিশের সঙ্গে যে তাঁরা বেরোতে পারেননি, তার কারণ রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। নাম না করে পর্ষদ কর্তাদের একাংশ দাবি করছেন, শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিদের একাংশই চান না, পর্ষদ অভিযানে নামুক। তাঁদের যুক্তি, জাতীয় পরিবেশ আদালত যখন বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু এখনও বলেনি, তখন ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নেই। বিশেষ করে এর সঙ্গে যখন বহু মানুষের রুজি রোজগার যুক্ত এবং তাঁরা ভোটব্যাঙ্কের অংশ।

এই অভিযোগের উত্তর দেওয়ার রাস্তায় যাননি রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি রবিবার শুধু বলেন, ‘‘পর্ষদ অভিযানে নেমেছে নাকি নামেনি, সেই ব্যাপারে খোঁজ না নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’’ কিন্তু শব্দবাজির বিরুদ্ধে অভিযানে নামার ব্যাপারে পর্ষদের উপরে কি নিষেধাজ্ঞা আছে? পরিবেশমন্ত্রীর উত্তর, ‘‘এটাও জানি না। খোঁজ না নিয়ে বলা যাবে না।’’ শোভনবাবু তৃণমূলের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সভাপতি। সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায় জানাচ্ছেন, রাজ্যে বাজি উৎপাদন ও ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ১১ লক্ষ মানুষ, যাঁদের ৫৫ শতাংশই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার।

কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে শব্দবাজির দাপট এই রাজ্যে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত অনেকটা স্তিমিত থাকলেও তার প্রত্যাবর্তনের শুরুটা হয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায়। এবং সেটা ছিল এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রথম সাফল্য। কী ভাবে? ২০০৪-এ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের পক্ষ থেকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে চিঠি দিয়ে শব্দবাজি ফেরাতে আবেদন জানানো হয়। তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী মানব মুখোপাধ্যায় কিন্তু বলেছিলেন, ‘‘কয়েক লক্ষ লোকের রুজি রোজগারের জন্য আমি তামাম রাজ্যবাসীকে নরকযন্ত্রণার মুখে ঠেলে দিতে পারি না।’’ কিন্তু মানববাবুকে শেষমেশ হার মানতে হয়। রাজ্যে ফাটবে না, এই শর্তে শব্দবাজি তৈরির অনুমতি দিতে বাধ্য হয় পর্ষদ। বাস্তবে অবশ্য ভিনরাজ্যে না গিয়ে সেই শব্দবাজির বেশির ভাগই এখানে ফাটে।

বামফ্রন্ট জমানায় খোলাখুলি শব্দবাজির পক্ষে সওয়াল করতেন সিপিএমের এক সাংসদ। ২০০৬-এর কথা। বড়বাজারে ধূপকাঠির প্যাকেটের মধ্যে লুকোনো বিপুল পরিমাণ শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করেছিল পুলিশ। তখন সব রকম শব্দবাজি তৈরি ও ব্যবহার গোটা রাজ্যে নিষিদ্ধ। তবু ওই সাংসদের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘তাতে কী হয়েছে? ওগুলো তো ১২৫ ডেসিবেল শব্দমাত্রার মধ্যে।’’ এখন সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতি স্বীকার করে নিচ্ছে, ওই সিপিএম নেতার প্রভাবেই এক চিলতে খুপুরি-কুঠুরিও পুরোদস্তুর বাজি কারখানা হিসেবে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছিল।

সেই ট্রাডিশনই পরেও চলেছে। ২০১৩-র সেপ্টেম্বরের কথা। পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি তৈরি ও ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে তখন সদ্য রায় দিয়েছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। এই নিয়ে পর্ষদের তদানীন্তন চেয়ারম্যান বিনয়কান্তি দত্ত একরাশ উদ্বেগ নিয়ে গিয়েছিলেন রাজ্যের এক মন্ত্রীর কাছে। রায়ের উপর স্থগিতাদেশ নেওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ করা উচিত, তা নিয়ে পরামর্শ করতে। কিন্তু বিনয়বাবুকে তাঁর কথার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘‘বছরে মাত্র কয়েকটা দিন শব্দবাজি ফাটে, আগেও ফেটেছে। এতে তো দুনিয়া রসাতলে যাচ্ছে না!’’

Police Diwali Fireworks
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy