কখনও প্রথম। কখনও বা দ্বিতীয়।
সব ক্ষেত্রেই প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়াটা জোর গলায় বলার মতো কথা নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নামটা যত নীচের দিকে আসে, ততই মেলে স্বস্তি। জোটে বাহবা। কিন্তু মানুষ পাচারে প্রথম বা দ্বিতীয় স্থানের মধ্যেই থাকছে পশ্চিমবঙ্গ। কোনও মতেই নামটা নীচে আর নামছে না। স্বস্তিও তাই অধরা। এবং উদ্বেগ ক্রমবর্ধমান।
১৪ ডিসেম্বর সংসদের রাজ্যসভায় এ রাজ্য থেকে মানুষ পাচার সংক্রান্ত রিপোর্টের প্রসঙ্গ ওঠে। তাতে দেখা যায়, মানুষ পাচারের পরিসংখ্যানে স্থান-বদল হয়নি পশ্চিমবঙ্গের। এই ধরনের অপকর্মে চার্জশিট বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও একই জায়গায় আছে বাংলা। প্রথমে রয়েছে অসম। দ্বিতীয় পশ্চিমবঙ্গ। এই নিয়ে দায়ের করা অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে। পুলিশও অভিযোগ জমা নিচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় চার্জশিট জমা পড়ছে কম। সাজার সংখ্যা আরও নগণ্য।
২০১৫-র রিপোর্টে বলা হয়েছে: অভিযোগ জমা পড়েছে ১২৫৫টি। কিন্তু চার্জশিট পেশ হয়েছে ৯৮১টি মামলায়। গ্রেফতার ১২৭৫ জন। তবে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১৪৬৮ জনের বিরুদ্ধে। আর ১৯টি ক্ষেত্রে সাজা পেয়েছে মাত্র ৬৮ জন! প্রশ্ন উঠছে, থানায় হাজারো রিপোর্ট এলেও চার্জশিট বা সাজা এত কম কেন?
পুলিশি সূত্রের খবর, ১৮ বছরের কম বয়সি ছেলে বা মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ জমা পড়া মাত্র তা এফআইআর হিসেবে গণ্য করে তদন্ত শুরু করতে হয়। থানা প্রথমে তদন্তে নামলেও পরে গুরুত্ব বুঝে সেই দায়িত্ব নেয় সিআইডি-র ‘অ্যান্টি হিউম্যান ট্র্যাফিকিং ইউনিট’ (এএইচটিইউ)। কিন্তু নিখোঁজের সংখ্যার তুলনায় এএইচটিইউ-এর তদন্তকারী অনেক কম। কয়েক বছর আগে প্রতিটি জেলায় এএইচটিইউ খোলা হয়েছিল। ওই ইউনিটের দায়িত্ব ডিস্ট্রিক্ট এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ বা ডিইবি-র যে-ডিএসপি-র উপরে ন্যস্ত, এএইচটিইউ ছাড়াও তাঁকে আরও তিনটি ইউনিট সামলাতে হয়। ফলে অভিযোগ এলেও গতি পায় না তদন্ত।
সিআইডি-র এক তদন্তকারী জানান, পাচারের অধিকাংশ মামলায় দেখা যাচ্ছে, কোনও ছেলের সঙ্গে আলাপের কিছু দিনের মধ্যেই তাকে বিশ্বাস করে বাড়ি ছাড়ছে নাবালিকা। সে জানতেও পারে না যে, তাকে সম্পর্কের ফাঁদে ফেলে ভিন্ রাজ্যে নিয়ে গিয়ে বেচে দেওয়া হবে। ‘‘সেই মেয়ে বাড়ি না-ফিরলে তদন্তে সমস্যা হয়। মেয়েটি কার সঙ্গে কোথায় গিয়েছে, তার হদিস পেতেই প্রচুর সময় লেগে যায়। ফলে অন্যান্য মামলায় দেরি হতে থাকে। ফলে চার্জশিটও জমা পড়ছে দেরিতে,’’ দেরির ব্যাখ্যা দিলেন ওই অফিসার।
গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, অনেক সময়েই পাচার হয়ে যাওয়া কিশোরী বা তরুণীকে উদ্ধারের পরে অভিযুক্ত ধরা পড়লেও মেয়েটিকে সাক্ষ্য দিতে দেয় না তার পরিবার। এ-সব ক্ষেত্রে পাচারকারী চক্রটি কারও মাধ্যমে প্রচুর টাকা দেয় মেয়েটির পরিবারকে। মেয়েটি সাক্ষ্য না-দেওয়ায় মামলা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে অভিযুক্ত লোকজন জামিন পেয়ে যায় সহজেই।
বেসরকারি সংস্থা শক্তিবাহিনী অবশ্য বলছে, অভিযুক্তদের যে অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তি হচ্ছে না, তার মূলে আছে দুর্বল চার্জশিট। ‘‘পুলিশ আগে অভিযোগ জমা নিত না। এখন নিচ্ছে। কিন্তু তার পরে চার্জশিটের দুর্বলতায় সাজা পাচ্ছে না পাচারকারী। এমন ধারায় মামলা ঠোকা দরকার, যাতে চার্জশিট মজবুত হয়,’’ বলছেন ওই সংস্থার ঋষিকান্ত।
একই বক্তব্য শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তীর। তিনি জানান, আইনের যথাযথ ধারা প্রয়োগ করে মামলা দিলে জামিন পাওয়া কঠিন হবে। ‘‘পাচারকারীদের কবল থেকে বেঁচে ফেরা মেয়েটির জন্য ঠিকঠাক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হলে পাচার চক্রের পক্ষে টাকা দিয়ে সেই মেয়ে বা তার পরিবারের মুখ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। রাজ্যের তরফ থেকে সেই চেষ্টাই চালানো হচ্ছে,’’ বললেন অনন্যাদেবী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy