আসন সংরক্ষণের গেরোয় রঘুনাথপুরে শাসকদলের দ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে এসেছে। ‘কঠিন সময়ে’ আসন্ন পুরনির্বাচনে সংরক্ষণের ঠেলায় গতবারের জেতা আসন ছাড়তে হচ্ছে উপপুরপ্রধান, পুরসভার দলনেতা এবং আরও এক তৃণমূল কাউন্সিলরকে। আর জেতা আসনে দাঁড়াতে না পেরে তৃণমূলের ওই অংশের কাউন্সিলরেরা ক্ষুদ্ধ দলের নেতৃত্বের উপরেই।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে যে তিন কাউন্সিলরের ওয়ার্ডগুলি এ বার সংরক্ষিত হয়েছে, তাঁরাই তিন বছর আগে বর্তমান পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিলেন। ফলে, তৃণমূলের নিচুতলার কর্মীদের একাংশ ইতিমধ্যেই এই অভিযোগ তুলতে শুরু করেছেন যে, বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীকে ‘শিক্ষা’ দিতে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ইন্ধনে সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে ওই তিনটি ওয়ার্ডকেই।
পুরুলিয়া জেলার তিনটি পুরসভায় (পুরুলিয়া, ঝালদা ও রঘুনাথপুর) আসন সরক্ষণের খসড়া তালিকা প্রকাশের পরে দেখা যাচ্ছে, রঘুনাথপুর পুরসভায় যে চারটি আসন তফসিলি জাতি ও তফসিলি জাতিভুক্ত মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হচ্ছে, তার মধ্যে তিনটি আসনই ছিল তৃণমূলের দখলে। তফসিলি জাতি (মহিলা)-র জন্য সংরক্ষিত হয়েছে দুই নম্বর ওয়ার্ডটি। এখান থেকেই গতবার পুরভোটে জিতেছিলেন উপপুরপ্রধান বাসুদেব তিওয়ারি। তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হচ্ছে ১৩ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর পুরসভায় তৃণমূলের দলনেতা বিষ্ণুচরণ মেহেতা। তফসিলি জাতি (মহিলা)-র জন্য সংরক্ষিত হচ্ছে রঘুনাথপুরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডটিও। এখানে প্রথমে নির্দল হিসাবে জিতেছিলেন দীনেশ শুক্ল। পরে তিনি যোগ দেন তৃণমূলে। তিন বছর আগে এই তিন তৃণমূল কাউন্সিলরের উদ্যোগেই অনাস্থা এসেছিল দলীয় পুরপ্রধান মদন বরাটের বিরুদ্ধে। অনাস্থা গৃহীত হয়নি। অনাস্থার তলবি সভায় বেনিয়মের অভিযোগ তুলে আদালতের দ্বারস্থ পর্যন্ত হয়েছিলেন এই তিন কাউন্সিলর।
ফলে দলের মধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয়েছে, ওই তিন কাউন্সিলরের আসন সংরক্ষণের আওতায় চলে যাওয়ার পিছনে কি অন্য সমীকরণ কাজ করছে? ওই তিন কাউন্সিলরই দাবি করেছেন, তাঁদের ওয়ার্ডের জনজাতির বিন্যাস অনুযায়ী সেগুলি সংরক্ষিত হতে পারে না। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে প্রশাসনের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন বাসুদেববাবু, বিষ্ণুচরণবাবুরা। তবে প্রশাসন সূত্রের খবর, আসন সংরক্ষণের খসড়া তালিকাই মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে থাকে। ফলে তালিকা অপিরবর্তিত থাকলে আখেরে বিপাকে পড়ছে তৃণমূলই। কারণ গতবারের বিজয়ী ওই কিন কাউন্সিলর নিজেদের ওয়ার্ডে দাঁড়াতে না পারলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। ইতিমধ্যেই লোকসভার ভোটের ফলের নিরিখে রঘুনাথপুর পুরসভার ১৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে পাঁচটিতে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। নিজের আসন চার নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপি-র চেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন খোদ পুরপ্রধান মদনবাবু। তার উপর আসন সংরক্ষণ নিয়ে দলের নিচুতলায় ক্ষোভ ধূমায়িত হওয়ার বিষয়টি চিন্তায় রেখেছে শাসকদলকে।
শুধু নিচুতলাতেই নয়, নিজের জেতা আসন সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ গোপন করছেন না তৃণমূল কাউন্সিলরদের একাংশও। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দীনেশ শুক্লর অভিযোগ, বিরোধিতা করার জন্যই পুরসভার চেয়ারম্যান তাঁর ওয়ার্ডটিকে সংরক্ষিত করিয়েছেন। দীনেশবাবু বলেন, “৭ নম্বর ওয়ার্ডে দলের মহিলাদের মধ্যে যোগ্য প্রার্থীর অভাব রয়েছে। তাই আমরা আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নির্বাচনে নিষ্ক্রিয় থাকব।” এমনকী, অন্য দল যোগ্য প্রার্থী দিলে প্রয়োজন তাঁকে সমর্থনের ইঙ্গিত পর্যন্ত দিচ্ছেন দীনেশবাবুর অনুগামীরা। অন্য দিকে, ২ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের একাংশ সাফ জানাচ্ছেন, অনাস্থা আনার কারণেই এই ওয়ার্ডটি সংরক্ষিত করে দিয়ে উপপুরপ্রধানকে দাঁড়াতে না দেওয়ার ‘চক্রান্ত’ করেছেন দলেরই নেতাদের একাংশ। যদিও এই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি বাসুদেববাবু। তিনি শুধু বলেছেন, “জনজাতির আনুপাতিক হারে ২ নম্বর ওয়ার্ড তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত হওয়া উচিত ছিল না।”
একই ভাবে এখনই প্রকাশ্যে আসন সংরক্ষণের জন্য দলের নেতৃত্বকে দুষছেন না বিষ্ণুচরণ মেহেতাও। যদিও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না এই বর্ষীয়ান নেতা। তাঁর ইঙ্গিতবাহী মন্তব্য, “ওয়ার্ডটি সংরক্ষিত হওয়ায় প্রশাসনের কাছে আপত্তি জানিয়েছি। তবে যদি আপত্তি গ্রাহ্য না হয়, তাহলে এই ওয়ার্ডে নির্বাচনের ফল তৃণমূলের পক্ষে যাবে কি না, সেটা ভবিষ্যতই বলবে।”
তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো অবশ্য বলেন, “নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে আসন সংরক্ষিত হয়। ফলে কোনও দল বা ব্যক্তি বিশেষের কোনও ভূমিকাই থাকে না। তা সত্ত্বেও আমরা প্রশাসনের কাছে জানতে চাইছি, কী ভাবে খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে।” তবে, জেতা আসনে প্রার্থীরা দাঁড়াতে না পারলে তার প্রভাব নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কাকে একেবারেই অমূলক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন শান্তিরামবাবু।
তৃণমূলে যখন বিক্ষোভের আঁচ, যখন আসন্ন পুরভোটকে পাখির চোখ করে শহরে দলীয় কাজকর্ম জোরকদমে শুরু করেছে বিজেপি। তার ফলও মিলেছে রঘুনাথপুর কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এবিভিপির ‘অভাবনীয়’ সাফল্যে। পুরসভায় আসন সংরক্ষণের গেরোয় তৃণমূলের অভ্যন্তরেই বেসুরো বাজার ঘটনা শুরু হওয়াতে পুরভোটেও ‘অপ্রত্যাশিত’ ফল করার আশায় গেরুয়া শিবির।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy