Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Narendra Modi Donald Trump

ভারত-মার্কিন সম্পর্কের সংস্কৃতি ও রাজনীতি

আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য ৩৫ ঘণ্টার ‘মেগা শো’র আয়োজন কেন? সঙ্গে দারিদ্রের চিহ্নকে পাঁচিল তুলে শহর থেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা। এ সব কিছুর পরে কী পড়ে থাকল ভারতের হাতে? প্রতিরক্ষামূলক সমঝোতা? তাহলে প্রশ্ন হল, কারা এই একপেশে বন্ধুত্ব চাইছে?

ভারত সফরে থাকাকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র

ভারত সফরে থাকাকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ফাইল চিত্র

গৌরীশঙ্কর নাগ
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২০ ০৩:০৬
Share: Save:

ভারত-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁরা এ বিষয়ে অবহিত যে, শুরু থেকেই ভারত-মার্কিন সম্পর্কে টানাপড়েন ছিল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধ- উত্তর পর্বের অস্বস্তি অতিক্রম করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উষ্ণতা এসেছে। এসেছিল তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ ও তদানীন্তন মার্কিন বিদেশ সচিব স্ট্রোব ট্যালবটের মধ্যে দীর্ঘ কথোপকথোনের মধ্য দিয়ে। যা নিয়ে ট্যালবটের বিখ্যাত বই ‘এনগেজিং ইন্ডিয়া’। এই সময় থেকে ভারত-মার্কিন ঘনিষ্ঠতার যে অধ্যায়ের সূচনা, তার থেকেও নজরকাড়া মোদীর দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা যা দেখেছি তাতে বেশ মালুম হচ্ছে সম্পর্কের রফাসূত্র কেবল নিখাদ আশাবাদ নয়, বরং আমরা যেন মরীচিকার দিকে তাকিয়ে। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষণা নিবন্ধে অতুল ভরদ্বাজ দেখিয়েছেন, অতীতে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকার ভারত বিরোধী অবস্থানের নিরিখে দেখলে, ভবিষ্যতে চিনা আগ্রাসনের মোকাবিলায় আমেরিকার হাত ধরা কতটা বিচক্ষণতার কাজ হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।

তাহলে প্রশ্ন হল, কারা এই একপেশে বন্ধুত্ব চাইছে?

সেটা জানতে গেলে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের সংস্কৃতি ও রাজনীতি জানা দরকার। যাঁরা আমেরিকার রাজনীতি জানেন, বিশ্বায়নের দৌলতে সেই উচ্চাভিলাষী ভারতীয় মোক্ষম জানেন যে, আমেরিকার রাজনীতি মূলত বিনিয়োগকারী ব্যাঙ্কার, শিল্পপতি ও অস্ত্রব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেখানে নৈতিকতা, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের মুখোশের কোনও স্থান নেই। আছে শুধু লাভক্ষতির চুলচেরা সওদাগরি। জেফারসনের গালভরা ‘এম্পায়ার অফ লিবার্টি’ বা উড্রো উইলসনের নৈতিক নেতৃত্বের কথা বাদ দিলে সাম্প্রতিককালে ক্লিন্টনের সময় গণতন্ত্র বা বারাক ওবামার আমলে সংখ্যালঘুর প্রতি যেটুকু সৌজন্য, মূল্যবোধ অবশিষ্ট ছিল, তা মুছে ফেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চরম জাতীয়তাবাদী পদক্ষেপগুলি বিশ্বব্যাপী আমেরিকার অবস্থানকে বিতর্কিত করে তুলেছে।

ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প এইচ-১ বি ভিসার ব্যাপারে যে কঠোর অবস্থান নিতে শুরু করেন তাতে মার্কিন মুলুকে কর্মসূত্রে যাওয়া ভারতীয় সফ্‌টঅয়্যার বিশেষজ্ঞদের পরিবার যারপরনাই আতান্তরে পড়ে। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে তিনি বেশ কয়েকটি ভারতবিরোধী পদক্ষেপ করেছেন। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল ‘জেনারেলাইজ়ড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স’-এর তকমা কেড়ে নেওয়া। ফলে সহস্রাধিক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে যে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পেত ভারত, তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

তাহলে এ হেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য ৩৫ ঘণ্টার ‘মেগা শো’র আয়োজন কেন? সঙ্গে দারিদ্রের চিহ্নকে পাঁচিল তুলে শহর থেকে লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা। কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছিল, এই সফরে দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষামূলক বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে যে কাঙ্ক্ষিত বাণিজ্যচুক্তির আশার ফানুসটি তৈরি করা হল, তা তো ফলপ্রসূ হলই না, উল্টে আশা করা হয়েছিল ইরান থেকে তেল আমদানির বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, আমরা সে ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় পাব, কিন্তু সে গুড়েও বালি। উল্টে আমরা যা পেলাম, তা মূলত সামরিক বা প্রতিরক্ষামূলক একটা সমঝোতা মাত্র। বুঝতে অসুবিধা হয় না এর লক্ষ্য দক্ষিণ এশিয়া তথা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভেদ, সামরিক উত্তেজনা ও জাতিগত হিংসাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা। ফলে দিনের শেষে হিসাবের খাতা খুলে বসলে এটা আর গোপন থাকে না যে আমরা তিনশত কোটি টাকা দিয়ে কয়েকটি মার্কিন হেলিকপ্টার কিনব।

কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারতের জাতীয় অর্থনীতির বর্তমান বেহাল অবস্থায় এই কপ্টার কেনা কি আদৌ প্রয়োজনীয় ছিল? নাকি এটা পরবর্তী আর একটা ‘বালাকোট’ স্ট্রাইকের প্রস্তুতি? অথবা চিনকে বার্তা? কারণ, ভারত-মার্কিন ‘কম্প্রিহেনসিভ স্ট্র্যাটেজিক গ্লোবাল এনগেজমেন্ট’-এর লক্ষ্য মূলত চিনকে চাপে রাখা। যদিও কয়েকমাস আগে আমরা দেখেছি দীর্ঘ বাণিজ্য যুদ্ধের পর অপারগ আমেরিকা চিনের সঙ্গে বাণিজ্য সমঝোতা করেছে। সেইসঙ্গে মনে রাখা দরকার ভারত-মার্কিন এই ঠুনকো প্রতিরক্ষা বন্দোবস্ত দিয়ে উচ্চাভিলাষী চিনের অগ্রগতিকে আটকানো প্রায় অসম্ভব। ইতিমধ্যেই চিনের সরকারি চ্যানেল জিনহুয়া ট্রাম্পের ভারত সফরের বিষয়টি ‘বাগাড়ম্বরপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছে। সেইসঙ্গে ভারতকে দেওয়া আমেরিকার সামরিক কপ্টার কতটা অত্যাধুনিক তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। যা প্রশ্ন জাগায়, তবে কি ভারত-মার্কিন ‘চুক্তি’ ‘অন্তঃসারশূন্য’?

সেই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে, তবে কেন আমরা এধরনের দৃশ্যগত বিভ্রমের আশ্রয় নিচ্ছি? তা বুঝতে হলে বুঝতে হবে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের পরিবর্তিত ‘সাংস্কৃতিক কানেক্ট’কে। আমরা অনেকটা পিছিয়ে গিয়ে উনবিংশ শতকে এমারসন বা হেনরি থরোর ভারতীয় (হিন্দু) শাস্ত্র সম্পর্কে যে উচ্চ ধারণা— তাকে ধরছি না। এমনকি, ভারত-সম্পর্কে পশ্চিমি দুনিয়ার যে কাল্পনিক ধারণা (ফ্যান্টাসি) তাকেও বোঝাচ্ছি না।

ভারত-আমেরিকার মধ্যে অভিচিন্তনগত যে পার্থক্য রয়েছে, যা আবর্তিত হয়েছে প্রগতিশীল, পশ্চিমি জাতির প্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে, যা ব্যক্তিকে সমাজ থেকে এবং সমাজকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছে, যে ‘মিরাকল’ দীর্ঘ ব্রিটিশ পরাধীনতার পরেও ভারতকে ফিনিক্স পাখির মতো পথ দেখিয়েছে, সেটাই আমেরিকার স্ট্রাটেজিক কমিউনিটিকে

আকৃষ্ট করেছে।

অবশ্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ১৯৯০ এর দশকের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন ভারতীয়েরা। স্বীকৃতি পেয়েছে সেই অভিবাসীদের কর্মকুশলতা ও সাফল্য। কিন্তু এই সময় থেকেই ভারত সম্পর্কে আমেরিকার ‘ধারণা’র মধ্যে ঢুকে পড়তে থেকেছে হিন্দুত্ববাদী যোগ।

সেই যোগ স্পষ্ট হল যখন আমরা দেখলাম ২০১৮ সালে ট্রাম্পের ভিসা-নীতির কঠোরতার মুখোমুখি হয়ে হোয়াইট হাউসের বাইরে জমায়েত হয়ে একদল ভারতীয় স্লোগান তুললেন, ‘ট্রাম্প হিন্দুদের ভালবাসেন, ভারতীয়েরা ট্রাম্পকে ভালবাসেন।’ বিষয়টি কিন্তু মোটেই লঘু নয়। বরং চমকে উঠে দেখি কত গভীরে রয়েছে এর রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা।

এখন প্রশ্ন হল, ট্রাম্পের আমেরিকা না চাইলে আমেরিকায় হিন্দুত্ববাদের এ হেন প্রচার ও প্রসার ঘটত কি? তাই আজকের উত্তর ঔপনিবেশিক দক্ষিণ এশিয়া যেমন ঐতিহাসিক সত্য, তেমনই অলক্ষে থেকে ভারত তথা উপমহাদেশের রাজনীতিকে চালিত করছে আমেরিকা, এটাও সত্য। ‘স্ট্রাকচারাল’ দিক থেকে ভাবলে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ও মোদীর ‘সবকা সাথ সব কা বিকাশ’ হয়ত একই মুদ্রার দু’টো পিঠ। তাই ট্রাম্পকে আসতেই হতো। পূবে চিনের করোনাভাইরাস ও পশ্চিমের তেলের মূল্য হ্রাসের টানাপড়েনের মাঝে আটকে, ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার খুব বেশি মূল্য আদৌ ছিল কি?

লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Donald Trump Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE