E-Paper

ডাইন অপবাদ পাওয়া মায়ের দেহদান মেয়ের

মৃত বৃদ্ধার ছেলে পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। অবিবাহিত মেয়ে বালিকার সঙ্গে থাকতেন বৃদ্ধা। ফুড়কির বিধবাভাতা এবং বালিকার লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় সংসার চলত।

রথীন্দ্রনাথ মাহাতো

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২৪ ০৮:২৮
মায়ের দেহদানের অঙ্গীকারপত্র হাতে বালিকা সিং।

মায়ের দেহদানের অঙ্গীকারপত্র হাতে বালিকা সিং। নিজস্ব চিত্র।

ডাইন অপবাদ দিয়ে গ্রামের কিছু বাসিন্দা এক আদিবাসী বৃদ্ধা ও তাঁর মেয়েকে হেনস্থা করছেন বলে বছর খানেক আগে অভিযোগ উঠেছিল। সেই বৃদ্ধার মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ গবেষণার জন্য শুক্রবার পুরুলিয়া মেডিক্যালকে দান করলেন মেয়ে। জানালেন, শীঘ্রই নিজেও দেহদানের অঙ্গীকার করবেন। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানের টাসগ্রামের বছর পঞ্চান্নর বালিকা সিং-এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন কুসংস্কার-বিরোধী আন্দোলনকারীরা থেকে আদিবাসী সংগঠন।

বুধবার মস্তিকের রক্তক্ষরণের সমস্যা নিয়ে বান্দোয়ান হাসপাতালে ভর্তি হন চিরুডি পঞ্চায়েতের টাসগ্রামের বৃদ্ধা ফুড়কি সিং (৮৮)। পরে পুরুলিয়া মেডিক্যাল তাঁকে স্থানান্তর করা হয়। এ দিন ভোরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এরপরেই মায়ের দেহ মেডিক্যাল কলেজকে দান করবেন বলে জানান মৃত বৃদ্ধার মেয়ে বালিকা সিং। সম্পতি জানান বালিকার দাদাও।

মৃত বৃদ্ধার ছেলে পরিবার নিয়ে আলাদা থাকেন। অবিবাহিত মেয়ে বালিকার সঙ্গে থাকতেন বৃদ্ধা। ফুড়কির বিধবাভাতা এবং বালিকার লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় সংসার চলত। অভিযোগ, ২০২১ সালে জমিজমা সংক্রান্ত ঝামেলায় গ্রামের কিছু বাসিন্দা মারধর করেন তাঁদের মা-মেয়েকে। হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন বালিকা। কিছু দিন পরে আবারও ডাইনি অপবাদ দিয়ে তাঁদের মারধর করে গ্রাম থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে দেওয়া হয়। বাড়ি ভাঙচুর করে তার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। নলকূপও খুলে দেওয়া হয়। যদিও অভিযুক্তেরা তা মানেননি। ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতিকে পাশে পেয়ে পুলিশ-প্রশাসনের কাছে ছুটে যান বালিকা।

বালিকার কথায়, ‘‘সবাই পাশে দাঁড়ানোয় ডাইন অপবাদ দিয়ে অত্যাচার করা থেমেছে। তবে আমরা খারাপ মানুষ নই। তাই মায়ের মৃত্যুর পরে ভাবলাম, তাঁর দেহ ভাল কাজেই লাগুক। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে দেহদানের ইচ্ছা প্রকাশ করি।’’ প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত যাওয়া বালিকার উপলব্ধি, ‘‘মাকে হারানোর কষ্টের মধ্যেও এটুকুই ভাল লাগার মতো ঘটনা। দেহদানে সবাই যেন এগিয়ে আসেন। খুব তাড়াতাড়ি আমিও দেহদান অঙ্গীকারবদ্ধ হব।’’

প্রত্যন্ত গ্রামে থেকে দেহদানের অঙ্গীকারের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে বিভিন্নমহল। ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো বলেন, ‘‘বালিকা সিং তাঁর মায়ের মৃতদেহ দান করার ইচ্ছার কথা আমাকে জানান।এরপরেই হাসপাতালে গিয়ে দেহদানের ব্যবস্থা করি।’’

আদিবাসী ভূমিজ কল্যাণ সমিতির পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক রামকৃষ্ণ সিং বলেন, “এটা খুব ভাল উদ্যোগ। তবে আমাদের এলাকায় এমনটা দেখা যায় না। যাঁরা এই বিষয়টি খারাপ চোখে দেখেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানো উচিত।’’

পুরুলিয়া মেডিক্যালের অ্যানাটমির বিভাগের শিক্ষক তুলসি মণ্ডল বলেন, ‘‘আমি ছ’মাস এখানে এসেছি। তার মধ্যে দু’জনের দেহ দান করা হয়েছে। এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সবাই এগিয়ে এলে এই ধরনের গবেষণার জন্য আমাদের আর অন্য মেডিক্যাল কলেজের উপরে নির্ভর করতে হবে না।’’

তবে এ নিয়ে চেতনা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের জেলা সম্পাদক তথা পুরুলিয়া মেডিক্যালের চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের উদ্যোগে ৭৮ জন দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন। আদিবাসীদের ক্ষেত্রে উৎসাহ একটু কম দেখা গেলেও সার্বিক ভাবেই সবার মধ্যে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bandowan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy