পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক অবরোধ। —নিজস্ব চিত্র
দলেরই এক কর্মীকে প্রকাশ্যে চটিপেটা করার অভিযোগ উঠল পুরুলিয়ার পাড়া পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি সীমা বাউরির বিরুদ্ধে। সেই অভিযোগকে ঘিরে বুধবার দুপুর থেকে তেতে উঠল পাড়া থানার আনাড়া এলাকা। সভাপতিকে গ্রেফতারের দাবিতে হল পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও, রাজ্য সড়ক অবরোধ। এমনকী, আন্দোলনে তৃণমূলের একাংশের পাশে সামিল হতে দেখা গেল কংগ্রেস এবং সিপিএমের স্থানীয় নেতা-কর্মীদেরও।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে রাত পর্যন্ত অভিযুক্ত তৃণমূল নেত্রীকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। রঘুনাথপুরের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সীমাদেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়েছে। তদন্ত শুরু হয়েছে।” তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের চাপে যথাযথ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ।
স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন সকালে আনাড়া বাজারে নিজের বৈদ্যুতিন সামগ্রীর দোকানে বসে ছিলেন তৃণমূল কর্মী স্বপন দেওঘরিয়া। অভিযোগ, হঠাৎই দোকানে ঢুকে তাঁর উপরে চড়াও হন সীমাদেবী। সঙ্গে ছিল তাঁর কিশোরী মেয়ে। ভরা বাজারে দোকানের ভিতর চটি খুলে স্বপনবাবুকে মারতে শুরু করেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। দোকানের স্ক্রু-ড্রাইভার তুলে নিয়ে সীমাদেবী স্বপনবাবুর মাথায় আঘাত করেন বলেও অভিযোগ।
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন আশপাশের লোকজন। পরে কয়েক জন প্রতিবাদ করতেই অবশ্য দোকান ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে যান সীমাদেবী।
কিন্তু কেন এই হামলা?
তৃণমূল সূত্রের খবর, স্বপনবাবুরা দলের পুরনো কর্মী। রাজ্যে পালাবদলের পরে অন্য অনেক ‘আদি’ তৃণমূল কর্মীর মতোই এখন নতুনদের দাপটে ‘কোণঠাসা’ তাঁরা। দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে স্বপন দেওঘরিয়াদের সম্পর্ক ‘মধুর’ নয়। সীমাদেবীর স্বামী সম্প্রতি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার এলাকার কয়েক জনের সঙ্গে ওই দুর্ঘটনার বিষয়ে কথা বলছিলেন স্বপনবাবু। সেই সময় তিনি সীমাদেবীর বিরুদ্ধে ‘কটুক্তি’ করেছিলেন বলে অভিযোগ ক্ষমতাসীন–শিবিরের একাংশের। সেই কটুক্তির ‘শিক্ষা’ দিতেই এ দিন স্বপনবাবুর দোকানে হামলা বলে মনে করছেন দলের অনেক কর্মী।
স্বপনবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘সীমাদেবীর স্বামীর দুর্ঘটনা নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করছিলাম। কিন্তু এমন কোনও মন্তব্য করিনি, যার জেরে এ ভাবে দোকানে ঢুকে আমাকে মারধর করবেন উনি।”
এই খবর চাউর হতেই এলাকায় ক্ষোভ ছড়াতে শুরু করে। সীমাদেবীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে স্বপনবাবুর সঙ্গে আনাড়া ফাঁড়িতে অভিযোগ জানাতে তৃণমূলের একাংশের পাশাপাশি যান কংগ্রেস, সিপিএমের স্থানীয় নেতারাও। অভিযুক্ত নেত্রীকে গ্রেফতার করার দাবিতে দলমত নির্বিশেষে স্থানীয় বাসিন্দারা ফাঁড়ির সামনে বিক্ষোভ-অবস্থানে বসে পড়েন। খবর পেয়ে পাড়া থানার ওসি দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কিন্তু, গ্রেফতারের দাবিতে অনড় জনতা পাল্টা জানিয়ে দেয়, সীমাদেবীকে দ্রুত ধরা না হলে রাস্তা অবরোধ হবে। সেই মত দুপুর দেড়টা নাগাদ আনাড়া বাসস্ট্যান্ডের সামনে পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়ক অবরোধ শুরু হয়। জোটের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অবরোধে দেখা যায় তৃণমূলের নিচুতলার বহু কর্মী-সমর্থককে।
পুলিশের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠার পরে তৃণমূলের একাংশ এবং জোটের নেতা-কর্মীরা ফের আনাড়া ফাঁড়িতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। কংগ্রেস নেতা বিপ্লব দেওঘরিয়া বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা জনপ্রতিনিধি তাঁর দলেরই এক কর্মীকে মারধর করেছেন। এলাকার বাসিন্দা হিসাবে সকলে ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন।” সিপিএমের আনাড়া লোকাল কমিটির সম্পাদক দীপক চৌবে বলেন, ‘‘ক্ষমতা পাওয়ার পরেই সীমাদেবীর মতো কয়েক জন নিজেদের এলাকার রাজা মনে করতে শুরু করেছেন। আগে কয়েকটি ঘটনায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এ দিন উনি মাত্রা ছাড়ানোয় মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন।”
অতীতেও সীমাদেবীর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। পঞ্চায়েত সমিতিতে নিজের ঘরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক মহিলাকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ওই মহিলা থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরে ভাগাবাঁধ গ্রামের নবকুঞ্জে এই ধরনের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় পুলিশের উপস্থিতিতে মীমাংসা হয়।
তবে, বুধবারের ঘটনায় অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে গিয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বলছে তৃণমূলেরই একাংশ। আম-জনতার ক্ষোভের আঁচ টের পেয়ে শাসকদলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতারাও বলতে বাধ্য হয়েছেন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। আনাড়া অঞ্চলের তৃণমূলের সভাপতি সজল দেওঘরিয়ার কথায়, ‘‘দল এই ঘটনাকে সমর্থন করে না। আইন নিজের পথেই চলবে।’’
জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, ‘‘কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিলে, সেটাকে দল কখনওই মেনে নেবে না।’’ কিন্তু দল কি এই বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা নেবে? এই প্রশ্নের জবাব মেলেনি।
এ দিন অনেক চেষ্টা করেও সীমাদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর মোবাইল বন্ধ ছিল। এসএমএস করেও উত্তর মেলেনি। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, আসানসোলের যে হাসপাতালে স্বামী ভর্তি আছেন, ঘটনার পরে সীমাদেবী সেখানে চলে গিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy