Advertisement
E-Paper

ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে খুন

প্রথমে বিস্ফোরণ। এ বার খুন! গত বুধবারই লোকপুরের নওপাড়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে আস্ত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। ঘটনার পিছনে জড়িত থাকা দুষ্কৃতীদের এখনও নাগাল পায়নি পুলিশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০২:১৯
এ ভাবেই সদর দরজা ভেঙে ফেলেছে দুষ্কৃতীরা। শনিবার বড়রা গ্রামে ছবিটি তুলেছেন দয়াল সেনগুপ্ত।

এ ভাবেই সদর দরজা ভেঙে ফেলেছে দুষ্কৃতীরা। শনিবার বড়রা গ্রামে ছবিটি তুলেছেন দয়াল সেনগুপ্ত।

প্রথমে বিস্ফোরণ। এ বার খুন!

গত বুধবারই লোকপুরের নওপাড়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে উড়ে গিয়েছে আস্ত অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। ঘটনার পিছনে জড়িত থাকা দুষ্কৃতীদের এখনও নাগাল পায়নি পুলিশ। তার ঠিক দু’দিনের মাথায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে নৃশংসভাবে এক তৃণমূল কর্মীকে খুন করল দুষ্কৃতীরা। কাঁকরতলা থানার বড়রা গ্রামে শুক্রবার রাত সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে এই হামলার ঘটনা। পুলিশ জানিয়েছে, নিহত তৃণমূল কর্মীর নাম শেখ খিলাফৎ (৫০)। থানার সীমারেখা বদলে গেলেও খয়রাশোলজুড়ে দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবের চেনা ছবিটা যে বদলানোর নয় তা এ দিন ফের প্রমাণিত হল!

একের পর এক অপরাধের ঘটনায় স্থানীয়দের ক্ষোভ, এলাকায় যতদিন অবৈধ কয়লা কারবার, আর বেআইনি ভাবে অস্ত্র মজুদে রাজনৈতিক ও পুলিশি মদত থকবে, ততদিন অশান্ত থাকবে এই ব্লক। তাঁদের দাবি, কেন না কয়লা কারবারের নিয়ন্ত্রণ রাখা নিয়েই তো নিত্য লড়াই। খিলাফৎ খুনের পিছনেও সেই একই সমীকরণ। তৃণমূল কর্মী খুনের ঘটনায় অবশ্য কয়লা কারবার নিয়ে সরাসরি মন্তব্য এড়ালেও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিহতের পরিবার এবং তৃণমূল নেতৃত্ব।

গত মাসের ১২ তারিখ কাঁকরতলা থানার পারশুণ্ডী থেকে ফেরার পথে আক্রান্ত হয়েছিলেন ওই কর্মী।

শেখ খিলাফৎ। — নিজস্ব চিত্র

সে সময় তাঁর পরিবারের অভিযোগ ছিল, আগ্নেয়াস্ত্র-সহ সমাজবিরোধীরা খিলাফতের উপর আক্রমণ করেছিল এবং তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল। বরাতজোরে সে দিন খিলাফৎ বেঁচে ফিরলেও, পুলিশ অভিযুক্ত সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। পরিবারে দাবি, উল্টে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছিল খিলাফতের স্ত্রী ও তাঁর নাবালিকা মেয়েকে। গ্রেফতার করা হয়েছিল গ্রামের কয়েকজনকেও। নিহতের ভাই শেখ আজিজুল, ছেলে বদিউজ্জামান, কাকা শেখ বদরুদের অভিযোগ, ‘‘পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করে বিপক্ষকে সমর্থন করেছে। সেই জন্যই এমন পরিণতি।’’

একই বক্তব্য নেতৃত্বেরও।

তৃণমূলের খয়রাশোলের ব্লক সভাপতি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুলিশ সঠিক ভূমিকা নিলে এ ভাবে প্রাণ যেত না আমাদের সক্রিয় কর্মী খিলাফতের।’’

পুলিশ অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চায়নি। ফোন ধরেননি পুলিশসুপার। তবে এলাকায় গিয়ে নিহতের পরিজনদের ক্ষোভের আঁচ পেয়েছেন ডিএসপি (হেডকোয়াটার) ধ্রুব দাস ও দুবরাজপুরের সার্কেল ইন্সপেক্টর দেবাশিস দাসেরা। স্থানীয়েরা বলছেন, ‘‘খিলাফৎকে যে রকম নৃশংসতায় খুন করা হয়েছে, তাতে এই ক্ষোভ স্বাভাবিক।’’ হামলা কেন, সে নিয়ে পুলিশ ও তৃণমূলের একাংশ জানাচ্ছে, পারশুণ্ডীর অবৈধ খাদান থেকে উত্তোলিত কয়লা বড়রা গ্রামের মধ্যে দিয়েই বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের অবৈধ খাদানের কয়লাও ওই পথেই আসে। সে দিক থেকে দেখলে বড়রা ভৌগলিক ভাবে এমন একটি গ্রাম, যেখানে থেকেই মূলত গোটা ব্লকের কয়লা সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে কয়েকজন প্রভাবশালী কয়লা কারবারীদের দ্বারা। এবং সেই সব কারবারীদের হাতে থাকে একাধিক দুষ্কৃতীও। নিজেদের কারবার মসৃণভাবে চালানোর জন্য কারবারিরা শাসকদলের হাত ধরে থাকে। কখনও বা সুযোগ বুঝে গোষ্ঠী পরিবর্তন করে থাকেন কয়লা কারবারীরা।

তবে, মূল বিষয়টি হল এলাকা দখল। বর্তমানে পঞ্চায়েতে যে পরিমান টাকা আসছে সেই টাকার ভাগ ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রাখতে পঞ্চায়েত দখলে রাখাও জরুরি। খিলাফতের সঙ্গে বিপক্ষের সংঘাতের কারণও সেটাই। কয়লা প্রসঙ্গ এড়িয়ে আগের বারে ১০০ দিনের টাকা টাকার ভাগ অন্যায় ভাবে চাওয়ার কারণে দাদার উপরে হামলা হয়েছিল জানিয়ে ছিলেন খিলাফতের খুড়তুতো ভাই তথা বড়রা গ্রামের নির্বাচিত তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্যে শেখ সাবের আলির।

শনিবার সকালে বড়রা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খিলাফৎদের দুটি বাড়ি— একটি পুরনো ও অন্যটি নতুন। গ্রামের মুন্সী পাড়ায় ওই তৃণমূল কর্মীর নতুন বাড়ির বাইরে স্থানীয়দের জমাট ভিড়। ভিতর থেকে ভেসে আসছে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। বাড়ির দেওয়ালে বোমা ফাটার চিহ্ন। নিহতের মা সাজেরা বিবি, স্ত্রী বদরুন্নেসা বিবি, মেয়ে পাপিয়া, সাফিয়ারা সমানে কেঁদে চলেছেন। কী ভাবে হল, জিজ্ঞাসা করতেই কান্না থামিয়ে বলেন, বদরুন্নেসা বিবি বলেন, ‘‘আমরা স্বামী স্ত্রী ও আমার বড় ছেলে পুরনো ঘরটায় ছিলাম। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জনা পনেরো–কুড়ির একটি দুষ্কৃতী দল দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢোকে।’’

খিলাফতের পরিবারের দাবি, দুষ্কৃতীরা বাড়িতে ঢোকার সময়ে বোমাবাজি করছিল। বাড়ির বারান্দায় বেরিয়ে আসতে তারা বদরুন্নেসা বিবি ও তাঁর ছেলেকে আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে আটকে রাখে। তারপর ঘরের দরজায় বোমা ছোড়ে। তাতে দরজা ভেঙে যায়। বদরুন্নেসা বলেন, ‘‘তাতেই বোধ হয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল স্বামী।’’ এরপরেই খিলাফতকে পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়ে চলে যায় দুষ্কৃতীরা। সে সময় পরিবারের চিৎকার শুনে পড়শিরা বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাঁদের পিছু হঠাতে বোমা ছোড়ে দুষ্কৃতীরা।

‘‘ওরা চলে গেলেও পিছু ছাড়িনি। পুলিশকে খবর দিই। পুলিশ যখন আসে তার আগেই সব শেষ। অনেক খোঁজাখুজির পরে গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়া অন্ডাল-পালাস্থলী রেল লাইনের ধারে রক্তাক্ত দেহটা মেলে। মাথায় বুকে কোমরে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে ওরা।’’ শনিবার সকালে দেহটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সিউড়ি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কে বা কারা ঘটনার পিছনে রয়েছে, শনিবার বিকেল পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনও লিখিত অভিযোগ হয়নি। নিহতের পরিজনদের মৌখিক দাবি, মুখ ঢাকা থাকলেও দুষ্কৃতীদের তাঁরা চিহ্নিত করছেন। নিহতের ভাই শেখ আজিজুল, ছেলে বদিউজ্জামান বলেন, ‘‘যাঁদের চেনা গিয়েছে সেই তালিকায় শেখ মহিবুল, শেখ সানু, শেখ হাসু, শেখ মধু বিট্টু খানেরা রয়েছে। আগের দিন হামলাতেও ওরাই জড়িত ছিল।’’

লিখিত অভিযোগ জানাননি কেন?

তাঁরা জানান, ‘‘কবর দেওয়ার পরেই থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের হবে।’’

coal murder
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy