সে রাতের বর্ণনা দিচ্ছেন বাঁকুড়ার কাঞ্চনপুরের ঘোষবাড়ির বধূরা।—নিজস্ব চিত্র।
অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে মেয়েকে বিয়েতে গয়না উপহার দিয়েছিলেন বাবা। সেই গয়না ডাকাতের হাতে চলে যেতে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিলেন বধূটি। ডাকাত দলের এক জন তাঁর দিকে ফিরে বলে, ‘‘বহন তু মুহ ঘুমালে।’’ (বোন তুই মুখ ঘুরিয়ে নে)। তারপর আলমারি খুলে হাতিয়ে নেয় গয়না, টাকাকড়ি— সব।
মঙ্গলবার মাঝরাতে বাঁকুড়া সদর থানার কাঞ্চনপুর এলাকার একটি বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালাল এক দল দুষ্কৃতী। পুলিশ জানিয়েছে, লুঠ হয়েছে নগদ প্রায় ৬০ হাজার টাকা-সহ প্রায় ৬ ভরি সোনার গয়না। তবে যে বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে, তার উপর তলায় একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা কার্যালয় থাকলেও সে দিকে পা বাড়ায়নি ওই দুষ্কৃতীরা।
বাঁকুড়া-রানিগঞ্জ ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে কাঞ্চনপুর এলাকায় বসবাস করেন পেশায় কেরোসিন ডিলার, ষাটোর্ধ্ব তীর্থপদ ঘোষ। তিনি শারিরীক ভাবে অসুস্থ হওয়ায় ইদানিং তাঁর ছেলেরাই ব্যবসা সামলান। পাশাপাশি তীর্থপদবাবুর বড় ছেলে দয়াময়বাবু ঠিকাদারির ব্যবসাও করেন।
পাঁচিল ঘেরা প্রায় আট কাঠা জমির উপর আটটি আলাদা আলাদা বাড়ি রয়েছে তীর্থপদবাবুর। একটিতে থাকেন সস্ত্রীক তীর্থপদবাবু, দয়াময়বাবু এবং তাঁর পরিবার। সেই বাড়ির উপর তলাটি ভাড়া দেওয়া রয়েছে ব্যাঙ্ককে। পাশের একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকেন তীর্থপদবাবুর ছোট ছেলে ননীগোপালবাবু।
ননীগোপালবাবু জানান, মঙ্গলবার রাত প্রায় পৌনে একটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাঁর। সেই সময় তিনি লক্ষ করেন, বাড়ির উঠোনে কাপড়ে মুখ ঢেকে কিছু লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিপদের গন্ধ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দাদা দয়াময় ঘোষকে ফোন করে বিষয়টি জানান ননীগোপালবাবু। পড়শিদের জাগানোর জন্য জানলা দিয়ে ‘‘চোর চোর’’ বলে চিৎকার করতে থাকেন তাঁরা। কিন্তু তাতে রক্ষা হয় না। কিছুক্ষণের মধ্যেই যন্ত্র দিয়ে দরজা ভেঙে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে দুষ্কৃতীরা। তাদের হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র।
ডাকাতরা প্রথমে হামলা চালায় দয়াময়বাবুর বাড়িটিতে। দয়াময়বাবুর দাবি, তাঁর হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয়। তাঁর স্ত্রী বুল্টিদেবীর থেকে চাবি নিয়ে বাড়ির কয়েকটি আলমারি খুলে, কিছু আলমারি ভেঙে নগদ টাকা ও গয়না হাতিয়ে নেয় তারা।
দাদার বাড়িতে যখন হামলা চালাচ্ছে ডাকাতরা, ননীগোপালবাবু সেই সময় কাছাকাছি বসবাস করা আত্মীয় স্বজনদের ফোন করে খবর দিতে শুরু করে দিয়েছিলেন। ডাকাতেরা কড়া নাড়ে তাঁর বাড়ির দরজাতেও। দরজা না খুললে দয়াময়বাবুকে গুলি করা হবে বলে হুমকি দেয় তারা। দরজা খুলে দেওয়ার পর তাঁকেও পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয় বলে দাবি করেন ননীগোপালবাবু। বিছানায় বসে তখন আতঙ্কে কাঁপছিলেন ননীগোপালবাবুর স্ত্রী সোমাদেবী এবং তাঁদের দু’বছরের শিশুকন্যা সোনাক্ষী। চাবি দিয়ে আলমারি খুলে গয়নার বাক্স বের করে আনে ডাকাতেরা। সোমাদেবী কেঁদে ফেললে তাঁকে মুখ সরিয়ে নিতে বলে বাক্স সমস্ত গয়না ভরে ফেলে ব্যাগে।
ননীগোপালবাবুর দাবি, আলমারি থেকে টাকা এবং গয়না লুঠ করার পর নগদ টাকা রাখার আসল জায়গা কোথায় তা জানার জন্য চাপ দিচ্ছিল ডাকাতেরা। সমস্ত টাকা আলমারিতেই ছিল বলায় তারা সে কথা বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু ফোনে খবর পেয়ে ততক্ষণে ঘোষ পরিবারের আত্মীয় স্বজনেরা জড়ো হতে শুরু করেছেন বাড়ির সামনে। তাঁরা চিৎকার করতে শুরু করেন। বেগতিক দেখে লুটের জিনিস নিয়ে দেওয়াল টপকে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। কিছুক্ষণে পর এলাকায় বোমের আওয়াজ শোনা যায়।
ডাকাতরা পালানোর পরে ননীগোপাল বাবু ফোনে পুলিশকে জানান। রাতেই ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করেন বাঁকুড়ার ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) বাপ্পাদিত্য ঘোষ এবং আইসি রাজর্ষি দত্ত। ননীগোপালবাবু বলেন, “আমরা এই এলাকার বরাবরের বাসিন্দা। আগে কখনও এ রকম ঘটনা ঘটেনি।’’ বুধবার সকালেও আতঙ্কের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি ঘোষ পরিবারের সদস্যেরা। ননীগোপালবাবুর স্ত্রী সোমাদেবী বলেন, ‘‘ওদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম সবাই। বিয়ের সমস্ত গয়না নিয়ে নেওয়ার সময় কেঁদে ফেলি। তাতেই ডাকাতদের এক জন মুখ ফিরিয়ে নিতে বলে।’’
ঘটনায় এলাকার নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, ওই বাড়িতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা কার্যালয় থাকা সত্বেও রাতে পুলিশের গাড়ি টহল দেয় না এলাকায়। অবিলম্বে এলাকায় পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি তুলেছেন তাঁরা। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে বাঁকুড়া সদর থানার তরফে দাবি করা হয়েছে, পুলিশ কর্মী মোতায়েন না থাকলেও গাড়ি করে এলাকায় টহল দেওয়া হয় রাতে।
কিন্তু পরপর চুরির ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়েছে বাঁকুড়া সদর থানার পুলিশ। এর আগেও গত এক মাসে এই থানা এলাকায় ১৩টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে শালবনী এলাকায় বাড়ি এবং দোকান মিলিয়ে ১২টি জায়গায় এক সঙ্গে হানা দিয়েছে চোরেরা। বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগান এলাকার সরকারি আবাসনের একটি বাড়ি থেকেও চুরির অভিযোগ উঠেছে। প্রতি ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে এলাকায় টহল না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সেই সময় পরিকাঠামোর অভাবের দোহাই দিয়ে দায় এড়িয়েছিল পুলিশ। স্থানীয় বাসিন্দাদেরই দল গড়ে এলাকায় রাত পাহারা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন পুলিশের আধিকারিকেরা।
কিন্তু দিন দিন বেড়ে চলা চুরি ডাকাতির মধ্যে পুলিশে ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশেরই একটি সূত্রের খবর, প্রকাশ্যে আসা অভিযোগের বাইরেও শহরের বেশ কিছু বাড়ি এবং দোকানে সম্প্রতি চুরি হয়েছে। সেই সমস্ত ঘটনায় থানায় কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। চুরির পর এ বার নৈরাজ্যের তালিকায় যুক্ত হল ডাকাতির নজির। কিন্তু এর পরও প্রতিক্রিয়া মেলেনি জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমারের। বুধবার সারা দিনে তিনি ফোন ধরেননি, জবাব দেননি এসএমএসেরও।
তবে জেলা পুলিশের কিছু আধিকারিক বিষয়টিকে বিচ্ছিন্ন ভাবে বাঁকুড়া সদর থানার পরিকাঠামোর সমস্যা হিসাবেই দেখছেন। যদিও চুরি-ডাকাতির ঘটনায় জেলার অধিকাংশ বাসিন্দাই আতঙ্কিত। জেলার অন্য এলাকার বাসিন্দারাও বাড়ি তালাবন্ধ রেখে বাইরে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার ডিআইজি বাস্তব বৈদ্য বলেন, ‘‘কোথায় সমস্যা হচ্ছে তা নিয়ে খোঁজ নিচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy