মলিন এলাকার কমিউনিটি হল। —নিজস্ব চিত্র
এ গ্রামের মেয়েরাও একসময় নাটকে অভিনয় করেছেন। এমনও হয়েছে, কোনও উৎসবে একই নাটকে গ্রামের কোনও মেয়ের সঙ্গে মঞ্চ কাঁপিয়ে অভিনয় করেছেন তাঁর স্বামী, শ্বশুড়-শাশুড়ি, নিজের বাবা!
আসলে, পাইকর গ্রামের নাট্য চর্চার সুখ্যাতি ছিল জেলাজুড়ে। এই ইতিহাসে ঘেরা কৃষি নির্ভর এলাকাই একসময় সংস্কৃতি চর্চায় সমৃদ্ধ ছিল। পাইকরের যাত্রা থিয়েটার নাটকের দলের জেলা এবং জেলার বাইরে একসময় যথেষ্ট সুনাম ছিল। গ্রামের মেয়েদের থিয়েটার-নাটক করার জন্য একসময় যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। গ্রামের বাসিন্দা যতীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে ছিল একটি ‘স্টেজবাড়ি’। এখন আগাছার জঙ্গলে পরিপূর্ণ সে বাড়ি। সেখানেই গ্রামের যাত্রা-থিয়েটারের রিহাসার্ল চলত দিনের পর দিন।
সে সব দিনের কথা বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা প্রজিতা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, তাঁর বাবা মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় গ্রামের নাটকে ছেলেদের সঙ্গে তিনি অভিনয় করেছিলেন নাটকে। গ্রামেই বিয়ে হয়েছে প্রজিতাদেবীর। অভিজ্ঞতা থেকে জানালেন, ‘‘এমনও হয়েছে তারাশঙ্করের ‘কালিন্দী’ নাটকে স্বামী অভিনয় করছে। শ্বশুড়-শাশুড়ি, বাবাও অভিনয় করেছে। এবং সবাই-নিজের আসল সম্পর্কের ভূমিকাতেই অভিনয় করেছে। কিন্তু এখন! সে সব কোথায়?’’
গ্রামের নাট্যকর্মী নবগোপাল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পাইকর গ্রামে আগে দুর্গাপুজো, নবান্ন উৎসব, সরস্বতী পুজো এবং হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে যাত্রা নাটক হত। কিন্তু ক্রমশ সেই তার ভাটা পড়ে গিয়েছে। তিরগ্রাম, রুদ্রনগর, গগনপুর, জাজিগ্রাম এই সমস্ত গ্রাম পাইকরের সংস্কৃতি চর্চা দেখে অনুপ্রাণিত হত।’’ পাইকর গ্রামে বাস করেন এক সময়ের মহিলা যাত্রা শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করা, পুরুষ শিল্পী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বৃন্দাবন বিহারী মণ্ডল। স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘‘বেনেপুতুল বলা হত আমাদের। মহিলা চরিত্রে ষাটের দশকের যাত্রাপালা সোনাইদিঘীর পালায় ‘মুক্তকেশী’-র চরিত্রের অভিনয় ভুলিনি এখনও। কিন্তু এখনকার যাত্রা পালা আর ভালো লাগে না। সেই উদ্যোগও নেই।’’
গ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মী রুপনাথ রায় জানালেন, পাইকর গ্রামের বাসিন্দা বীরেন্দ্র মোহন গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, দুর্গাদাস ঘোষ, ছায়া গঙ্গোপাধ্যায়, মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, নোটন চট্টোপাধ্যায়, মোজাফর হোসেনরা ছিলেন এলাকার নাট্যচর্চার প্রাণপুরুষ। পাইকর গ্রামের বাসিন্দা লেখক দীনবন্ধু দাস বলেন, ‘‘৮০ র দশকে দুর্গাদাস ঘোষের পরিচালনায় গ্রামে নাটক চর্চার ক্ষেত্রের স্বর্ণময় যুগ। কলকাতার যন্ত্রশিল্পী বারিণ চট্টোপাধ্যায় শব্দের বিশেষ ব্যবহার করে নাটক কাজ করেছিলেন। দুর্গাদাস ঘোষ-সহ গ্রামবাসীর উদ্যোগে পাইকর গ্রামের নবারুণ সংঘের জায়গায় একটি কমিউনিটি হল তৈরি হয়।
তার বেহাল দশা দেখে অনেকেই অবশ্য বলেন ওটা কমিউনিটি হল নয়, বিড়ির কারখানা। পাইকর গ্রামের নাট্যচর্চার বর্তমান ধারক অসিত পালোধি দাবি, ‘‘পাইকর গ্রামের নাট্যচর্চার ধারাবাহিকতাকে তুলে ধরতে গ্রামের ১৯০০ সাল থেকে ২০১৪ পর্যন্ত গ্রামের নাটক নিয়ে একটি প্রদর্শনী গত ১২ জানুয়ারি স্বামীজির জন্মদিনে করা হয়েছিল। কিন্তু, এখন সেই চর্চাতেও ভাটা পড়েছে উপযুক্ত স্টেজের অভাবে।’’ জানা গেল, পাইকর হাই স্কুল এবং গার্লস হাইস্কুল দুটি স্কুলেই পাকা স্টেজ আছে। সেখানে নাটক হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু সব সময় ওই স্টেজ পাওয়া যায় না।
নাট্যকর্মী অসিত পালোধি, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সাংস্কৃতিক কর্মী রুপনাথ রায়, রাজনৈতিক কর্মী সৌমেন মূখোপাধ্যায়, আসিফ ইকবালরা জানালেন, পাইকরে দর্শাকাসন যুক্ত মঞ্চ বা অডিটোরিয়াম আজও তৈরি হয়নি। যে কমিউনিটি হল আছে, তার শব্দ ও আলোর ব্যবস্থা ভালো নেই। ছাউনি উপযুক্ত না হওয়ায় খুবই গরম। তাঁদের দাবি, ‘‘আধুনিক মডেলের রবীন্দ্র সদন তৈরি করা হোক।’’ মুরারই ২ ব্লকের বিডিও শমিত সরকার বলেন, ‘‘কমিউনিটি হলে কোনও কিছু সরকারি অনুষ্ঠান সঠিক ভাবে করা যায় না। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত জায়গা পেলে ভালো মঞ্চ যুক্ত আধুনিক মডেলের অনুষ্ঠান ভবন নির্মাণ করা যেতে পারে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy