Advertisement
০৭ মে ২০২৪
কোথাও এটিএম বন্ধ, কোথাও ব্যাঙ্কে মিলছে সামান্য টাকা

মাস পয়লাতেও হাত খালি

মাস পয়লায় ব্যাঙ্কে গিয়ে বেতন তোলা যাবে তো? পেনশন নিতে গিয়ে এই বয়সে আর দুর্ভোগে পড়তে হবে না তো? সংশয় ছিলই। আর সেই আতঙ্কেই বৃহস্পতিবার অনেকে আর ব্যাঙ্কমুখোই হলেন না।

পুঞ্চায় মাইনে তুলতে এসে অনেকে দেখলেন এই নোটিস। (ডান দিকে) পুরুলিয়া শহরের ব্যাঙ্কে প্রতীক্ষায় বৃদ্ধ। —নিজস্ব চিত্র ও সুজিত মাহাতো।

পুঞ্চায় মাইনে তুলতে এসে অনেকে দেখলেন এই নোটিস। (ডান দিকে) পুরুলিয়া শহরের ব্যাঙ্কে প্রতীক্ষায় বৃদ্ধ। —নিজস্ব চিত্র ও সুজিত মাহাতো।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৬ ০২:০৩
Share: Save:

মাস পয়লায় ব্যাঙ্কে গিয়ে বেতন তোলা যাবে তো? পেনশন নিতে গিয়ে এই বয়সে আর দুর্ভোগে পড়তে হবে না তো? সংশয় ছিলই। আর সেই আতঙ্কেই বৃহস্পতিবার অনেকে আর ব্যাঙ্কমুখোই হলেন না। আবার যাঁরা গেলেন, তাঁরা ব্যাঙ্কে বিশেষ ভিড়ভাট্টা না দেখে খুশি হলেও চাহিদা মতো টাকা না পেয়ে শুকনো মুখে বাড়ি ফিরলেন। আবার কোথাও কোথাও সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্ক খোলার পরে গ্রাহকেরা জানতে পারেন, ব্যাঙ্কের হাতেই টাকা নেই। এটিএম-এ গিয়েও টাকা না পেয়ে অনেককে ফিরতে হয়েছে।

বস্তুত দুই জেলার বিভিন্ন এলাকায় এ দিন সকাল থেকেই ব্যাঙ্কগুলির সামনে ছিল গ্রাহকদের লম্বা লাইন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সরকারি কর্মী ও পেনশনভোগী। লাইনে থাকা লোকজনদের মধ্যে অনেককেই বলতে শোনা গিয়েছে, মাসের গোড়াতেই ছেলেমেয়ের টিউশন থেকে সংসারের মাসকাবারি খরচ, ওষুধ, বিদ্যুৎ, টেলিফোনের বিল প্রভৃতি প্রচুর খরচ রয়েছে। অথচ হাত ফাঁকা। তাই এ দিন ব্যাঙ্ক থেকে বেতনের একটা বড় অংশই অনেকে তুলে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক থেকে তাঁদের অনেককেই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে।

মাসের প্রথম দিনে মাইনের টাকার বেশির ভাগ অংশই তুলে ফেলেন বেশির ভাগ সরকারি কর্মীরা। তবে এ বার তা করতে পারেননি ব্যাঙ্কে টাকার পরিমাণ কম থাকায়। বাঁকুড়া শহরের অধিকাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কেই সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলা গিয়েছে এ দিন। কোথাও কোথাও আবার তার চেয়েও অনেক কম টাকা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।

বাঁকুড়া শহরের কাটজুড়িডাঙার মিলনপল্লি এলাকার বৃদ্ধা উমারানি লায়েক বলেন, “আমি পেনশন পাই। বৌমাকে ১০ হাজার টাকার চেক দিয়েছিলাম পেনশনের টাকা তুলে আনতে। তবে ব্যাঙ্কে মাত্র দু’হাজার টাকা দিয়েছে।” তিনি জানাচ্ছেন, মাসের শুরুতে তাঁকে দুধওয়ালা, বাড়ির পরিচারিকা, মুদি খানা সহ আরও কিছু জায়গায় টাকা মেটাতে হয়। তিনি বলেন, “ওই টাকা পাওনাদারদের ধারটাও মেটাতে পারব না। আবার ব্যাঙ্কে ছোটা ছাড়া উপায় নেই।” কাটজুড়িডাঙার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক প্রান্তিক পাত্রের কথায়, “হাতে নগদ টাকা বলতে কিছুই নেই। মাইনে তুলতে গিয়ে দশ হাজারের বেশি পেলাম না। এই টাকাতে টেনেটুনে সাতটা দিনও চালাতে পারব না।”

শহরের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক খুবই পরিমিত টাকা পাঠিয়েছে। সেই টাকা সকলে যাতে কিছু কিছু করে অন্তত হাতে পান সেই কারণেই টাকা তোলার মেয়াদ কমিয়ে দিতে হয়েছে। শহরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলেন, “পর্যাপ্ত টাকা না পেয়ে অনেকেই আমাদের কাছে নালিশ জানাতে আসছেন। কিন্তু আমাদেরও কিছু করার নেই। গ্রাহকদের আমরা বলছি এই অবস্থায় যতটা সম্ভব চেকে, ই-ব্যাঙ্কিং বা মোবাইল অ্যাপসে বিল মেটানোর পথে হাঁটতে।”

ঘটনাচক্রে নগদ টাকা সঙ্কটের এই জটিল সময়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে চেক ব্যবহার করা শুরুও করেছেন। বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগান এলাকার বাসিন্দা বাঁকুড়া মগরা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মুকেশ পাত্র বলেন, “ব্যাঙ্কের রেকারিং ও লোনের টাকা এ বার বাধ্য হয়েই চেকে দিয়েছি। তবে পাড়ার মুদি দোকানি ও ওষুধ দোকানির কাছে ‘পিওএস’ মেশিন নেই। ছেলের গৃহশিক্ষক ও ডাক্তাররা নগদ টাকা ছাড়া নেবেন না। বাড়ির কাজের লোকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। তাদের তো নগদেই দিতে হবে। হাতে মেরে কেটে ২০০ টাকা রয়েছে। মাসের প্রথম দিন ব্যাঙ্কে ব্যাপক ভিড় হবে ভেবে বেতন তুলতে যাইনি। কী ভাবে খরচ মেটাবো জানি না।’’

এ দিন আবার পুঞ্চা বাজারের একটি রাস্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সকাল থেকেই বহু মানুষ লাইন দিয়েছিলেন। ব্যাঙ্ক খোলার পরে হঠাৎ এক কর্মী কম্পিটারে ছাপানো একটি কাগজ সাঁটিয়ে চলে গেলেন। তাতে লেখা, ‘টাকার জোগান না থাকায় ১ ও ২ ডিসেম্বর টাকা তোলা যাবে না’। এতে অনেকেই চটে যান। পুঞ্চা বাজারের বাসিন্দা প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক বিপত্তারণ রক্ষিত বলেন, ‘‘মাসের ১ তারিখে পেনশনের টাকা তুলব বলে এসেছিলাম। হঠাৎ ব্যাঙ্কের লোক এসে জানান, টাকা নেই তাই দেওয়া যাবে না। ওই পেনশনের টাকা না তুললে খরচ সামলাব কী ভাবে বুঝতে পারছি না।’’

আর এক পেনশনভোগী পুঞ্চার লৌলাড়া গ্রামের বাসিন্দা প্রাক্তন পুলিশ কর্মী অবণীভূষণ চক্রবর্তীর প্রশ্ন, ‘‘আমার টাকা আমিই তুলতে পারছি না। কী হচ্ছে?’’ তবে পুঞ্চার ওই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সুবোধ টোপ্পো বলেন, ‘‘টাকা দেওয়া বন্ধ আমরা এমন কথা বলিনি। টাকার জোগান না থাকায় ১ ও ২ ডিসেম্বর আপাতত টাকা তোলা যাবে না। বুধবার পর্যন্ত আমরা টাকা দিয়েছি। আশা করছি শীঘ্র টাকা এসে যাবে।’’

পুরুলিয়া শহরে আবার ব্যাঙ্কগুলির থেকে এ দিন ভুগিয়েছে এটিএম। শহরের বিভিন্ন এটিএমের দরজায় দরজায় ঘুরেও টাকা মিলল না। কেউ গ্রামাঞ্চলের এটিএমে টাকা না পেয়ে শহরে এসেছিলেন, কেউ কাজে অন্য জেলা থেকে পুরুলিয়া শহরে এসেছেন, কারও মাইনে হয়ে গিয়েছে মাসের প্রথম দিনে— এটিএমের দরজা থেকে সবাইকে ফিরে যেতে হয়েছে খালি হাতে। বৃহস্পতিবার পুরুলিয়া শহরের অফিস পাড়ার বেশিরভাগ এটিএম কাউন্টার ঘুরে এমনই ছবি চোখে পড়েছে।

শহরের প্রাণকেন্দ্রে ট্যাক্সিস্ট্যান্ড বা হাসপাতাল মোড় সংলগ্ন এলাকায় জেলাশাসকের অফিস, পুলিশ সুপারের অফিস, জেলা পরিষদ, পুরসভা, খাদ্য ভবন, অনগ্রসর শ্রেণিকল্যাণ দফতর, শিল্প দফতর, সদর হাসপাতাল, পূর্ত দফতর, ডাকঘর, টেলিফোন ভবন, জেলা আবগারি দফতর-সহ একাধিক সরকারি দফতর রয়েছে। কাছেই বাসস্ট্যান্ড। এই এলাকা ঘিরেই রয়েছে কাপড়ের বাজার-সহ নানা দোকানপাট। ফলে সকাল থেকেই শহরের এই এলাকায় থিকথিকে ভিড় থাকে। স্বভাবতই ভিড় থাকে এটিএম কাউন্টারগুলিতেও। কিন্তু দেখা গিয়েছে, হাসপাতাল মোড়, সাহেববাঁধ রোড সহ লাগোয়া এলাকায় একের পর এক এটিএমের ভিতরে টাকার আশায় ঢুকে হতাশ হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন লোকজন।

আসানসোলের মহিশিলা এলাকার বাসিন্দা দিব্যেন্দু চক্রবর্তী পুরুলিয়া শহরে এসেছিলেন কাজে। হাজার দুয়েক টাকার জন্য সকাল থেকে একটার পর একটা এটিএমে ঘুরেছেন। তিনি বলেন, ‘‘সকাল থেকে আটটা এটিএমে ঘুরলাম। কোথাও টাকা নেই। বাড়ি ফেরার ভাড়া-সহ অল্প কিছু টাকা পড়ে রয়েছে। খুবই সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।’’

পুরুলিয়া জেলার জয়পুর থানার বাঁশগড় থেকে শহরে টাকার খোঁজে এসেছিলেন বিভূতিভূষণ পরামাণিক। হাসপাতাল মোড়ের একটি এটিএম থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘‘আমাদের এলাকার এটিএমে টাকা পাচ্ছি না, তাই শহরে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু তিন-চারটে এটিএম ঘুরলাম, কোথাও টাকা পেলাম না। মায়ের ওষুধ কেনার জন্য টাকার খুব দরকার ছিল।’’ একই অভিজ্ঞতা ঝালদা ২ ব্লকের চ্যেকা গ্রামের বাসিন্দা নিতাইচন্দ্র কুমারেরও।

একই ভোগান্তির শিকার সরকারি কর্মীরাও। অ্যাকাউন্টে মাইনের টাকা ঢুকে গিয়েছে। কিন্তু একের পর এটিএমের দরজা থেকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে জেলা শিক্ষা দফতরের কর্মী কাশীপুরের বাসিন্দা সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে। দুপুরে টিফিনের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে এটিএমের দরজায় ঢুঁ মেরেছিলেন বিদ্যুৎ দফতরের কর্মী পুরুলিয়ার বাসিন্দা সোমশুভ্র বরাট ও রঘুনাথপুরের বাসিন্দা শেখ মোজাহির। তাঁদেরও হতাশ হতে হয়েছে।

সাহেববাঁধ রোডের একটি রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধক আশিস চট্টোপাধ্যায় ও ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের একটি রাষ্টায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধক রাজকিশোর সাহু বলেন, ‘‘আমাদের হাতে যেটুকু টাকা রয়েছে, তা দিয়ে আমরা ব্যাঙ্ক চালাচ্ছি।’’ আর একটি ব্যাঙ্কের শাখা প্রবন্ধক বিজয়কুমার মিশ্র জানান, তাঁদের এটিএমের ক্যালিবারেশন বদল হবার কারণেই পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে।

আজ শুক্রবার ভোগান্তির ছবিটা বদলায় কি না অপেক্ষায় বাসিন্দারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation Pensioners
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE