Advertisement
০২ মে ২০২৪

এক গ্রাম এক পুজো, স্কুলের পাশে সবাই

নিজের শিক্ষারত্নের টাকায় স্কুলের ছাদে বৈদ্যুতিন প্যানেল বসিয়ে খুদে ছাত্রছাত্রীদের রাতের আকাশ চেনার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ বার আকাশের প্রকৃতি পরিবর্তন অনুধাবন করাতে সরস্বতী পুজোয় গ্রামবাসীদের একসূত্রে বাঁধলেন লাভপুরের কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রদীপ সিংহ।

চলছে প্রজেক্টর। —নিজস্ব চিত্র।

চলছে প্রজেক্টর। —নিজস্ব চিত্র।

অর্ঘ্য ঘোষ
লাভপুর শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:৪০
Share: Save:

নিজের শিক্ষারত্নের টাকায় স্কুলের ছাদে বৈদ্যুতিন প্যানেল বসিয়ে খুদে ছাত্রছাত্রীদের রাতের আকাশ চেনার ব্যবস্থা করেছিলেন। এ বার আকাশের প্রকৃতি পরিবর্তন অনুধাবন করাতে সরস্বতী পুজোয় গ্রামবাসীদের একসূত্রে বাঁধলেন লাভপুরের কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রদীপ সিংহ।

আদিবাসী অধুষ্যিত ওই গ্রামে ১৫২টি পরিবারের বাস। অধিকাংশের জীবিকাই দিনমজুরি। একসময় ওই গ্রামের বড় সংখ্যক ছেলেমেয়েই স্কুলে যেত না। সেই ছবিটা বদলাতে শুরু করে ২০০৯ সালে এলাকার ওই স্কুলে পার্থবাবু প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেওয়ার পর থেকে। গান, গল্প, নাটকের পাশাপাশি মিড-ডে মিলের ব্যবস্থাপনাতেও ছাত্রছাত্রীদের আকৃষ্ট করে স্কুলমুখী করে তোলেন তিনি। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১০২। ওই সাফল্যের জন্য এ বার রাজ্য সরকার তাঁকে শিক্ষারত্ন পুরস্কার দেয়। পুরস্কারের টাকায় স্কুলঘরের ছাদে বৈদ্যুতিন প্যানেল বসিয়ে প্রোজেক্টারের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের রাতের আকাশ চেনানোর ব্যবস্থা করেন পার্থবাবু। তার পরেই তিনি ঠিক করেন, একই ভাবে প্রতিমাসে কীভাবে আকাশের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটে তা-ও পড়ুয়াদের চোখের সামনে তুলে ধরবেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অর্থ সঙ্কট। সেই সঙ্কট দূর করতেই সরস্বতী পুজোকে হাতিয়ার করেন পার্থবাবু।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গত বছর পর্যন্ত ওই গ্রামে স্বল্প বাজেটের ছোট ছোট ৬টি সরস্বতী পুজো হয়েছে। এ বারও সেই তোড়জোড় শুরু হয়। তখন ওই সব পুজো কর্তাদের নিয়ে স্কুলে বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে পার্থবাবুরা প্রস্তাব দেন, ৬টির পরিবর্তে স্কুলের পুজোটিকেই ভাল করে আয়োজন করা হোক। তাতে সব দিক থেকে ভাল হয়। গ্রামবাসীদের উপর চাঁদার চাপ কমে যাওয়ার পাশাপাশি একই খরচে সব দিক সামাল দিয়েও উদ্বৃত্ত টাকায় স্কুলের জন্য উন্নয়নমূলক কিছু করা যায়। প্রস্তাবটি মনে ধরে গ্রামবাসীর। তাই আলাদা আলাদা পুজোর পরিবর্তে এ বার স্কুলেই সামিল হয়েছেন সকলে।

বছর পাঁচেক ধরে আলাদা ভাবে পুজো করছেন সোম মাড্ডি, ঠাকুর হেমব্রম, সুনীল কর্মকার, ফাল্গুনী সোরেনরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘আলাদা পুজো করতে গিয়ে চরম চাপে থাকতে হতো আমাদের। পুজোটাই কেবল হতো। কিন্তু অর্থাভাবে কোনও আনন্দ অনুষ্ঠান করা সম্ভব হতো না। কিন্তু এ বার সবার সংগৃহীত টাকায় একত্রে পুজোয় নাটক, পঙ‌্ক্তি ভোজ ঘিরে আমাদের অনেক বেশি আনন্দ হচ্ছে।’’ পুজো কমিটির সভাপতি জহরলাল সোরেন এবং সম্পাদক শিবনাথ কিস্কু জানান, যেহেতু প্রতিমা, ঢাক, পুরোহিত-সহ সব কিছুই এক খরচে হচ্ছে, তাই সব দিক সামাল দিয়েও বেশ কিছু টাকা স্কুলের উন্নয়নে দেওয়া যাবে।

সেই টাকাতেই পড়ুয়াদের আকাশের প্রকৃতি পরিবর্তন অনুধাবনের ব্যবস্থা গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। বুধবার তার প্রতিরূপও প্রদর্শিত হয়। কেমন সেই প্রতিরূপ? কালো পর্দা দিয়ে অন্ধকার একটি ঘরের ভিতরে রাখা হয় বাঁশ এবং আর্ট পেপারের তৈরি ৫ ফুট ব্যাসের আরও একটি গোলাকার ঘর। সেই ঘরের ছাদের মাথায় প্রোজেক্টারের মাধ্যমে পালা করে ৩-৪ ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবককে দেখানো হয় মাস পরিবর্তনের সঙ্গে কেমন ভাবে বদল ঘটে আকাশের।

তা দেখে মহা খুশি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ফুলমনি সোরেন, দ্বিতীয় শ্রেণির সোনু মুর্মুরা বলছে, ‘‘এত দিন আমরা বইয়ে পড়েছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম। আর ভুল হবে না।’’ খুশি অভিভাবকেরাও। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য ধনা হাঁসদা, মোড়ল রাম সোরেনরা বলেন, ‘‘এ বার আমাদের চাঁদার চাপ অনেক কম। অথচ আনন্দ হয়েছে অনেক বেশি। স্কুলে আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন একটা জিনিসও গড়া হবে।’’

পার্থবাবু জানান, স্কুলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই তিনি দেখতেন, বিক্ষিপ্ত ভাবে বেশ কিছু পুজো হয়। গ্রামবাসীর উপরে চাঁদার চাপ পড়ে। অথচ সেই অনুপাতে আনন্দ অনুষ্ঠান হয় না। ‘‘তখন থেকেই এটা মাথায় ছিল। সবাইকে একত্রিত করে সংগৃহীত টাকায় একটাই পুজো করলে আনন্দের পাশাপাশি অর্থ সাশ্রয়ও হয়। সেই টাকায় উন্নয়নমূলক কাজও করা সম্ভব। তাই গ্রামবাসীদের কাছে আর্জিটা রাখি। উদ্বৃত্ত টাকায় প্রতিরূপটা বড় আকারে স্থায়ী ভাবে করা সম্ভব হবে বলেই মনে হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Projector villagers School
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE