Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ছুটির দিনে দিঘায় কাজ কৃষি-কর্মীদের

পরপর দু’দিন ছুটি পেয়ে সরকারি কর্মীদের অনেকেই কাছেপিঠে ঘুরে আসছেন। নিতুড়িয়া ব্লকের কৃষি দফতরের কর্মীরাও এই ছু’টিতে দিঘা গেলেন। তবে এই দিঘা পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র সৈকত নয়।

ইদের দিনে মাঠে নেমে চাষিদের বীজ শোধনের কৌশল শেখাচ্ছেন কৃষি আধিকারিককেরা।—নিজস্ব চিত্র

ইদের দিনে মাঠে নেমে চাষিদের বীজ শোধনের কৌশল শেখাচ্ছেন কৃষি আধিকারিককেরা।—নিজস্ব চিত্র

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
নিতুড়িয়া শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৬ ০১:৪৩
Share: Save:

পরপর দু’দিন ছুটি পেয়ে সরকারি কর্মীদের অনেকেই কাছেপিঠে ঘুরে আসছেন। নিতুড়িয়া ব্লকের কৃষি দফতরের কর্মীরাও এই ছু’টিতে দিঘা গেলেন। তবে এই দিঘা পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র সৈকত নয়। ব্লকেরই একটি পঞ্চায়েত এলাকা। ছুটির দিনটা তাঁরা কাটালেন চাষিদের হাতে কলমে বীজ এবং বীজতলা শোধনের পদ্ধতি শিখিয়ে।

বৃহস্পতিবার দিনভর নিতুড়িয়ার ভামুরিয়া এবং দিঘা পঞ্চায়েত এলাকার পাঁচটি গ্রামে ঘুরেছেন কৃষি দফতরের কর্মী ও আধিকারিকেরা। ব্লকের সহকারি কৃষি আধিকারিক পরিমল বর্মন বলেন, ‘‘ইদের ছুটিতে অফিস বন্ধ ছিল। এই সুযোগে দু’টি পঞ্চায়েত এলাকায় ঘুরে আসা গেল। এর পরে যাওয়া হবে রায়বাঁধ আর গুনিয়াপাড়া পঞ্চায়েতে। এই শনি আর রবিবার সেটাও সেরে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’’

কিন্তু ছুটির দিনে কাজ কেন?

পরিমলবাবু জানান, চাষের ভরা মরসুম চলায় দফতরে এখন তুমুল ব্যস্ততা। বীজ নেওয়ার জন্য চাষিদের ভিড় লেগেই থাকে। তার মধ্যে দফতর ছেড়ে কর্মী এবং আধিকারিকেরা দফতর ছেড়ে গ্রামে গ্রামে গেলে সমস্যা হবে। তাই ছুটির দিনগুলিতেও তাঁরা কাজে ডুবে থাকছেন। দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, ব্লকের সাতটি পঞ্চায়েত এলাকাতেই ধাপে ধাপে গিয়ে চাষিদের বীজ শোধন শেখানো হবে। যে এলাকাগুলিতে চাষ বেশি হয়, সেখানে আগে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কর্মী এবং আধিকারিকেরা।

এই মরসুমে চাষিদের বীজ শোধনের পদ্ধতি শেখাতেই বা কেন মরিয়া হয়ে উঠল দফতর? দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, সমস্ত চাষেই বীজবাহিত রোগ থেকে অনেক ক্ষতি হয়। সরকার থেকে সমস্ত চাষিকে বিনামূল্যে ভাল বীজ সরবরাহ করা সম্ভব নয়। অধিকাংশ চাষিই বাজার থেকে বীজ কেনেন। সেই বীজের গুণগত মান আগেভাগে বোঝা সম্ভব নয়। তাই আপাতত ফসলের ক্ষতি সামাল দিতে বীজ শোধনের আগাম সতর্কতা ছাড়া উপায় নেই। এই মরসুমে পুরুলিয়ায় এখনও বিশেষ বৃষ্টি না হওয়ায় ভাল ফলন পেতে বীজশোধন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।

দফতর সূত্রের খবর, বীজ বোনার আগে যাতে চাষিরা শোধন করে নেন, তা নিশ্চিত করতে রাজ্য কৃষি দফতর থেকে ইতিমধ্যেই জেলায় নির্দেশিকা এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রে জেলার কিছুটা হলেও পিছিয়ে রয়েছে। দফতরের এক আধিকারিক জানান, রাজ্য চাইছে বীজতলা তৈরির আগেই চাষিরা বীজ শোধন করুক। এ দিকে জেলার প্রায় সর্বত্রই বীজতলা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। চাষিরা শোধন না করেই বীজতলা তৈরি করে ফেলেছেন।

বৃহস্পতিবার নিতুড়িয়ার দু’টি পঞ্চায়েত এলাকায় ঘুরে কৃষি দফতরের কর্মীরা নিজের চোখেই ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছেন। ব্লকের সহকারি কৃষি আধিকারিক পরিমলবাবু জানান, এ বছর নিতুড়িয়া ব্লকে ৭৫৪৫ হেক্টর জমিতে আমনধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। বীজতলা তৈরি হবে তার দশ শতাংশ জমিতে। ইতিমধ্যেই তার ৭০ ভাগ কাজ সারা হয়ে গিয়েছে। তিনি জানান, গত দু’সপ্তাহে নিতুড়িয়া এলাকায় বেশ কিছুটা বৃষ্টি হওয়ায় তড়িঘড়ি বীজতলা তৈরি করে ফেলেছেন চাষিরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বীজ শোধন করেননি।

এই পরিস্থিতিতেও উপায় রয়েছে। দফতরের কর্তারা জানান, বীজতলা শোধন করেও শুকনো বীজ শোধনের মতো ফল মিলতে পারে। রোপনের আগে একটি মাটির পাত্রে এক লিটার জলে দেড় গ্রাম কার্বেন্ডাজিম নামে একটি রাসায়নিক গুলে তাতে বীজতলা ডুবিয়ে রাখতে হয়। খরচ হয় মাত্র ৮-১০ টাকা। কিন্তু এতেই বীজবাহিত রোগে বড়সড় ক্ষতির থেকে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। পরিমলবাবুর দাবি, এই ভাবে বীজতলা শোধন করে ধান বুনলে বীজবাহিত রোগের সম্ভাবনা কম করে পঞ্চাশ শতাংশ কমে যায়।

এ দিন ভামুরিয়া পঞ্চায়েতের কুইরিপাড়া, আসনমণি, আলকুশা এবং দিঘা পঞ্চায়েতের বিন্দুইডি ও ভস্কো গ্রামে গিয়ে চাষিদের হাতে কলমে বীজ এবং বীজতলা শোধনের প্রক্রিয়া শিখিয়েছেন কৃষি দফতরের কর্মীরা। ব্লক কৃষি দফতরের দাবি, আগাম প্রচার করে রাখায় প্রতিটি গ্রামেই শতাধিক চাষি উপস্থিত ছিলেন। অনেকের মতোই বীজতলা তৈরির আগে বীজ শোধন করেননি কুইরিপাড়ার রামচন্দ্র কুইরি, ভস্কোর বাবুরাম হাঁসদা, আলকুশার হরিপদ টুডুরা। এ দিন দফতরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলার পরে তাঁরা বলেন, ‘‘চাষের আগে বীজশোধন করে নিতে কৃষি দফতর বলেছিল। কিন্তু তালেগোলে সেটা করা হয়নি। এখনও যে উপায় রয়েছে, জানতাম না। এ বার শিখে নিলাম যখন আর ভুল হবে না।’’

অবশ্য চাষিদের জন্য কৃষি দফতরের কর্মী এবং আধিকারিকদের চেয়ার-টেবিল ছেড়ে মাঠে নেমে আসা এর আগেও দেখেছে রঘুনাথপুর মহকুমা। স্কুল-কলেজের শিক্ষক বা সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের বদলি আটকাতে যেমন সাধারণ মানুষের একজোট হওয়ার দৃষ্টান্ত উঠে এসেছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এই মহকুমাতে তেমনই রয়েছে কৃষিকর্তার বদলি আটকাতে চাষিদের একজোট হওয়ার নজির। রঘুনাথপুর-১ এবং পাড়া ব্লকের কৃষি উন্নয়ন আধিকারিক (এডিও) ছিলেন জহরলাল ভৌমিক। দু’ বছরেই এলাকার চাষিদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষের সমস্যার সমাধান করতেন। ‘শ্রী’ পদ্ধতিতে কম জলে ধান চাষের কৌশল হাতে কলমে শেখাতেন। তাঁর পদোন্নতিকে বদলি ভেবে জেলা থেকে রাজ্য কৃষিদফতর অবধি দরবার করেছিলেন এলাকার চাষিদের একাংশ। নিতুড়িয়া ব্লক কৃষি দফতরের কর্মী ব্রজগোপাল চট্টোপাধ্যায়, ঘনশ্যাম দাস অধিকারী, পাগল মাজিরাও আপাতত ছুটির তোয়াক্কা করছেন না। তাঁরা বলেন, ‘‘বৃষ্টি হওয়া বা না হওয়া তো প্রকৃতির হাতে। কিন্তু আমাদের ছুটির বদলে যদি চাষিরা যদি লোকসানের হাত থেকে রক্ষা পান, সেটাই অনেক বড় পাওনা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Digha Farm-workers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE