Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বাজারে দাম নেই, খেত ভরা কপি নিয়ে বিপাকে চাষিরা

খেত ভর্তি সব্জি। অথচ গোটা মাস বিভিন্ন হাটে ঘুরেও মাসের শেষে ছেলের কাছে টাকা পাঠাতে পারবেন কিনা, জানেন না ওন্দা থানার বেলাটুকরি গ্রামের গোপাল পাত্র। জাতচাষি গোপালবাবু এ বারও বাঁধাকপি, ফুলকপির চাষ করেছেন।

মজুত আছে। বিক্রিবাটা কম। কাশীপুরের বাজারে। ছবি:প্রদীপ মাহাতো।

মজুত আছে। বিক্রিবাটা কম। কাশীপুরের বাজারে। ছবি:প্রদীপ মাহাতো।

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:৫৯
Share: Save:

খেত ভর্তি সব্জি। অথচ গোটা মাস বিভিন্ন হাটে ঘুরেও মাসের শেষে ছেলের কাছে টাকা পাঠাতে পারবেন কিনা, জানেন না ওন্দা থানার বেলাটুকরি গ্রামের গোপাল পাত্র। জাতচাষি গোপালবাবু এ বারও বাঁধাকপি, ফুলকপির চাষ করেছেন। ভেবেছিলেন, শীতের বাজারে সুদে-আসলে পুষিয়ে নিতে পারবেন বছরভরের খাটাখাটুনি। তাঁর আক্ষেপ, খাটনিই সার। ওন্দা-সহ বাঁকুড়ার বিভিন্ন বাজারে ফুলকপি-বাঁধাকপির দাম তলানিতে। স্থানীয় বাজারে মাথা কুটেও দাম না মেলায় বাধ্য হয়ে গাড়ি ভাড়া করে ছুটতে হচ্ছে পাশের জেলা পুরুলিয়ার বিভিন্ন হাটে।

সেখানেও ছবিটা এক। গোপালবাবুর কথায়, ‘‘এ বার হাজার চারেক ফুলকপি, হাজার আটেক বাঁধাকপি চাষ করেছিলাম। কিন্তু, কোথাও দাম পাচ্ছি না। পুরুলিয়ার বিভিন্ন হাটে যাচ্ছি যদি কিছুটা দাম মেলে।’’ এমনিতে পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ অংশের চাহিদা মেটায় বাঁকুড়ার সব্জি। কিন্তু, এ বার কপির ফলন অত্যধিক হওয়ায় চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি। ফলে পুরুলিয়াতেও বাজার পাচ্ছেন না গোপালবাবুর মতো ওন্দার ওই অঞ্চলের আরও অনেক চাষিই। তাঁরা জানাচ্ছেন, কাশীপুর, মানবাজার, আদ্রা, রঘুনাথপুর—পুরুলিয়ার সব বাজারের একই অবস্থা।

কাশীপুরের সাপ্তাহিক হাটে বাঁধাকপির পসরার পাশে দাঁড়িয়ে গোপালবাবু বলছিলেন, ‘‘আগের হাটে বড় সাইজের বাঁধাকপি দশ টাকা জোড়া বিক্রি করেছি। এক একটা বাঁধাকপি আড়াই থেকে তিন কেজি ওজনের। এখন ৬ টাকা করে দাম বললেও খদ্দের নিতে চাইছে না। অথচ, এই হাটে সব্জি নিয়ে আসতে গাড়ি ভাড়াই লেগেছে প্রায় দেড় হাজার টাকা!’’ বেলাটুকরি গ্রামেরই চাষি সুধাংশু বিশ্বাস, স্বপন বিশ্বাসদের একই অভিজ্ঞতা। তাঁরা জানালেন, হাটে আসার এক দিন আগে থেকে মাঠ থেকে ফসল তুলতে হয়। তার খরচ, বীজের দাম, ওষুধের খরচ তো রয়েইছে। তার উপরে পরিশ্রম। হাটে নিয়ে আসার খরচই কপি প্রতি তিন টাকা। ‘‘তার পরেও ৬ টাকায় বিক্রি করতে পারছি না’’—বলছিলেন সুধাংশুবাবু। গোপালবাবুর খেদ, ‘‘মেয়ে কলেজে পড়ে। আমরা স্বামী-স্ত্রী ও মেয়ে মিলে পরিশ্রমের দামটুকুও জুটছে না। ছেলে মুম্বইতে আইআইটিতে পড়ছে। মাস শেষে কী ভাবে টাকা পাঠাব জানি না।’’

ওন্দারই নিকুঞ্জপুরের বাসিন্দা মিলন পাল বলেন, ‘‘আমি হাজার পাঁচেক বাঁধাকপি লাগিয়েছি। না বেচতে পারলে প্রচুর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ব। গাড়ি ভাড়া করে পুরুলিয়ার হাটে এনে পাঁচ টাকা করেও বিক্রি হল না। তাই পাইকারী ব্যবসায়ীদের বিক্রি করে দিয়ে গেলাম কপি প্রতি মাত্র ২ টাকায়।’’ ওই গ্রামেরই বাসিন্দা জয়দেব পাত্র স্নাতক হওয়ার পরে চাকরি না পেয়ে চাষের কাজে নেমেছেন। বলছিলেন, ‘‘দশ হাজার কপি লাগিয়েছি। এখন পর্যন্ত হাজার দুয়েক বিক্রি হয়েছে। বাজারের যা হাল, তিন টাকা পিস বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।’’ বাকি কপি কী ভাবে বেচবেন, তা ভেবে কূল-কিনারা করে উঠতে পারছেন না ওই যুবক।

পুরুলিয়ার চাষিদের অভিজ্ঞতাও অন্য রকম নয়। কাশীপুরের গগনাবাদ গ্রামের কানাই নন্দী জানান, চলতি মরসুমে কপির আমদানি প্রচুর। কী ভাবেই বা দাম উঠবে! একই কথা বলছেন বলরামপুরের শ্যামনগর গ্রামের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ লাই বা প্রবোধ লাই। প্রবোধবাবু হাজার ছয়েক কপি চাষ করেছিলেন দাম পাবেন বলে। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথম দিকে তা-ও প্রতি পিস কপি প্রতি ৬-৭ টাকায় বেচতে পেরেছি। এখন তো স্রেফ দেড় থেকে দু’টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি।’’

চাষিরা সব্জির দাম পাচ্ছেন না, এই অভিযোগ তুলে ইতিমধ্যেই প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়েছে ফরওয়ার্ড ব্লক। দলের পুরুলিয়া জেলা সভাপতি নিশিকান্ত মেহেতা বলেন, ‘‘জলের দরের চেয়েও সস্তায় চাষিরা টোম্যাটো ও বাঁধাকপি, ফুলকপি বেচতে বাধ্য হচ্ছেন। উৎপন্ন ফসলের দাম তো দূরের কথা, পরিশ্রমের দামটুকুও পাচ্ছেন না তাঁরা। সরকার এই চাষিদের জন্য কী ভাবছে, আমরা জানতে চাই।’’ জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো বলেন, ‘‘সরকার কিসান মান্ডি গড়ে তুলেছে ব্লকে ব্লকে। বলা হয়েছিল মান্ডি চালু হলে চাষিরা দাম পাবেন। বাস্তব পুরো উল্টো।’’

জেলা কৃষি বিপণন দফতরের আধিকারিক সুধীর মাঝি জানিয়েছেন, চাহিদার তুলনায় এ বার জেলা জুড়ে কপির উৎপাদন বেশি হওয়াতেই এই পরিস্থিতি। জেলার বিভিন্ন কিসান মান্ডিগুলি দ্রুত চালু করার চেষ্টা চলছে। সেগুলি চালু হয়ে গেলে চাষিরা কিছুটা বেশি দাম পাবেন বলে তাঁর আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cabbage Farmers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE