Advertisement
১৭ মে ২০২৪
তাণ্ডব রামপুরহাট হাসপাতালে

চিকিৎসক হেনস্থায় বেআব্রু নিরাপত্তা

কিছু দিন পরেই যে হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের তকমা পেতে চলেছে, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কত ঠুনকো তা দেখিয়ে দিল মঙ্গলবারের চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হীরককান্তি দাসকে হেনস্থা করা হচ্ছে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন নিরাপত্তা রক্ষীরা।

জেলা হাসপাতালে তদন্তে এল পুলিশ। মঙ্গলবার সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

জেলা হাসপাতালে তদন্তে এল পুলিশ। মঙ্গলবার সব্যসাচী ইসলামের তোলা ছবি।

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:৩৬
Share: Save:

কিছু দিন পরেই যে হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের তকমা পেতে চলেছে, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কত ঠুনকো তা দেখিয়ে দিল মঙ্গলবারের চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক হীরককান্তি দাসকে হেনস্থা করা হচ্ছে দেখে এগিয়ে এসেছিলেন নিরাপত্তা রক্ষীরা। মারমুখী জনতা তাঁদেরও রেয়াত করেনি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। চোখের সামনে সে সব দেখে ততক্ষণে টেবিলের তলায় সেঁধিয়ে গিয়েছিলেন নার্সেরাও!

মঙ্গলবার রামপুরহাট হাসপাতালে বলিরাম প্রসাদ ভকতের মৃত্যুর পরে হাসপাতালে রীতিমতো তাণ্ডব চলায় তাঁর পরিজনেরা। মৃতের ছেলে কুন্দন প্রসাদ ও তাঁর আত্মীয়দের অভিযোগ, ‘‘হাসপাতালে বিনা চিকিৎসায় পড়ে থেকে বলিরাম প্রসাদের মৃত্যু হয়েছে।’’ চিকিৎসকদের অবশ্য দাবি, তাঁদের তরফে কোনও ত্রুটি ছিল না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই রামপুরহাট পুর এলাকার আট নম্বর এলাকার বাসিন্দা ওই বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। বুকে, মাথায় গভীর ক্ষতও ছিল।

এ দিকে, হাসপাতালে তাণ্ডবের সময়ে রামপুরহাটের পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারির উপস্থিতিতে আবার বিতর্ক দানা বেঁধেছে। হাসপাতালের কর্মী থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের অনেকেরই অভিযোগ, ‘‘জরুরী বিভাগের চিকিৎসককে হেনস্থা থেকে শুরু করে ভাঙচুর ও চার তলার পুরুষ বিভাগে টেনে-হিঁচড়ে হীরককান্তিবাবুকে নিয়ে যাওয়া— সবটাই হয়েছে পুরপ্রধানের চোখের সামনে।’’ এক ধাপ এগিয়ে অনেকের আবার অভিযোগ, তাঁর প্রশ্রয়েই গোটা ঘটনা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এমন অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন অশ্বিনীবাবু। তাঁর দাবি, ‘‘আমি খবর পেয়ে যখন হাসপাতালের চার তলায় ভর্তি থাকা রোগীর কাছে যাই তখন দেখি, দু’জন নার্স ছাড়া কোনও চিকিৎসক ডিউটিতে নেই।’’ তিনি উপস্থিত না থাকলে আরও বড় ঘটনা ঘটে যেতে পারত বলে দাবি পুরপ্রধানের।

হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী ও কর্মীদের অনেকেই জানিয়েছেন, রীতিমতো মারমুখী মেজাজে ছিল ওই পরিজনেরা। নীচের তলার জরুরি বিভাগ থেকে চার তলা পর্যন্ত দাপিয়ে বেরিয়েছে রোগীর সঙ্গে আসা পঞ্চাশ জনেরও বেশি লোকজন। গেট আটকে রেখে তারা জরুরি বিভাগের টেবিল, চেয়ার উল্টে দেয়। পরে উপরে উঠে চার তলায় পুরুষ বিভাগে কর্তব্যরত নার্স, চিকিৎসকদের টেবিলও উল্টে দেয়। ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অক্সিজেন সিলন্ডার, স্যালাইন বোতল, ইনজেকশন।

সকাল দশটা নাগাদ ভাঙচুরের পরে চার তলার পুরুষ বিভাগে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে রয়েছেন রামপুরহাট মহকুমা প্রশাসনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, হাসপাতাল সুপার সুবোধকুমার মণ্ডল, রামপুরহাট থানার আইসি-সহ হাসপাতাল অন্য কর্মীরা। ঘণ্টা দেড়েক পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। হাসপাতাল সুপার জানিয়েছেন, প্রত্যক্ষদর্শী চিকিৎসক, নিরাপত্তা কর্মীরা তাঁর কাছে ঘটনার বিবরণ লিখিত ভাবে জানিয়েছেন। পুলিশের কাছে দায়ের করা লিখিত অভিযোগে সে সব জানিয়েছেন তিনি।

গোটা ঘটনায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে চিকিৎসকদের মধ্যে। ইএনটি-র চিকিৎসক তরুণকান্তি পাত্রের প্রশ্ন, ‘‘দস্তুরমতো চিকিৎসা করানোর পরেও রেহাই পাননি ওই চিকিৎসক। কথায় কথায় নিগ্রহ তো চলছেই! এমনটা কবে বন্ধ হবে বলতে পারেন?’’ চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-এর (ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) রামপুরহাট শাখার সম্পাদক, চিকিৎসক দেবব্রত দাস অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার করে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন। হেনস্থার শিকার হীরককান্তিবাবু সুপারের সামনেই সাংবাদিকদের জানান, টানা আট বছর এই হাসপাতালে কাজ করছেন। কখনও কেউ গাফিলতির অভিযোগ করেননি। সেই তাঁকেই হেনস্থার মুখে পড়তে হল। বলছেন, ‘‘আঘাতটা যতটা না শরীরে, তার চাইতে মনে অনেক বেশি পেয়েছি।’’

এ দিকে, রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২০১১ সালে জুলাই মাস থেকে দু’জন করে চিকিৎসক থাকার কথা বলা হলেও রামপুরহাট হাসপাতালে এখনও সেই নির্দেশ মানা হয় না। কেন? সুপার সুবোধকুমার মণ্ডল বলছেন, ‘‘কী করে মানব? চিকিৎসকই তো নেই! স্বাস্থ্যভবনে সে কথা সবিস্তারে জানিয়েছি।’’ হাসপাতালে এখনই অন্তত দশ জন ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার দরকার, তা-ও জানাচ্ছেন তিনি।

এ দিনের ঘটনা বেআব্রু হয়েছে হাসপাতালের নিরাপত্তাও। হাসপাতাল সূত্রের খবর, পুরনো ভবন এবং সুপার স্পেশ্যালিটি মিলিয়ে সাকুল্যে ২৯ জন বেসরকারি নিরাপত্তা রক্ষী রয়েছেন। অথচ প্রয়োজন প্রায় দ্বিগুণ। এঁদের কারও কাছেই থাকে না কোনও আগ্নেয়াস্ত্র। ভরসা শুধু লাঠি। ‘‘তা দিয়ে কি আর এই ধরনের বিক্ষোভ সামাল দেওয়া সম্ভব’’, প্রশ্ন তুলছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রক্ষীই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Security Hospital
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE