Advertisement
০৭ মে ২০২৪

শিল্পাঞ্চলের প্রচারে শিল্পই বাদ

ভোটে যাচ্ছে রঘুনাথপুর। গত পাঁচ বছরে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব হবে এই ভোটে। অথচ অদ্ভুত ভাবে ভোট-প্রচারে শিল্পায়নই নেই! পুরুলিয়ায় শিল্পাঞ্চল হিসাবে পরিচিত রঘুনাথপুরে এটা ব্যতিক্রম বইকি।

রঘুনাথপুর শিল্পাঞ্চল পার্কের বোর্ড-ই সার।

রঘুনাথপুর শিল্পাঞ্চল পার্কের বোর্ড-ই সার।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৬ ০৩:১৭
Share: Save:

ভোটে যাচ্ছে রঘুনাথপুর। গত পাঁচ বছরে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব হবে এই ভোটে। অথচ অদ্ভুত ভাবে ভোট-প্রচারে শিল্পায়নই নেই!

পুরুলিয়ায় শিল্পাঞ্চল হিসাবে পরিচিত রঘুনাথপুরে এটা ব্যতিক্রম বইকি। কারণ, গত বিধানসভা থেকে পঞ্চায়েত, মাঝে লোকসভা নির্বাচন—বারবারই রঘুনাথপুরে ভোট যুদ্ধ আবর্তিত হয়েছে শিল্পায়নকে ঘিরে। গত বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের প্রচারের মূল বিষয়ই ছিল, রঘুনাথপুরকে ঘিরে তারা শিল্প গড়বে। তৃণমূল পাল্টা বলেছিল, সাড়ে তিন দশকের শাসনে রঘুনাথরপুরে বামেরা শিল্প বলতে গড়েছে দূষন তৈরি করা স্পঞ্জ আয়রন কারখানা। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের প্রচারে এসে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে তাঁরাই প্রকৃত পরিবেশবান্ধব ভারী শিল্প গড়বেন এলাকায়। বাস্তব বলছে, তার পর থেকে পাঁচ বছরে দামোদর নদে অনেক জল বয়েছে। কিন্তু, বিধানসভা এলাকার শিল্প পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি।

গত সাত-আট বছর ধরে রঘুনাথপুরে নানা শিল্পগোষ্ঠী প্রকল্পের জন্য বিনা বাধায় জমি অধিগ্রহণ এবং কারখানা গড়ার শিলান্যাস দেখে আসা স্থানীয় মানুষ ভেবেছিলেন, হাল বদলাতে চলেছে শিল্প-পরিস্থিতির। শিল্পের হাত ধরে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এলাকার অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন অনেকে। কিন্তু, সে-সবই স্বপ্ন থেকে গিয়েছে। কোনও বড় শিল্প-প্রকল্পই গড়ে ওঠেনি এই অঞ্চলে। শিবরাত্রির সলতের মতো টিঁকে রয়েছে ডিভিসির তাপবিদ্যুৎ কারখানা। সে-ও আবার জমি জট ও আর্থিক সঙ্কটে ধুঁকছে। ফলে, পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোটের মতো এ বারও রঘুনাথপুরে শিল্পায়ন না হওয়ায় শাসকদলের বিপক্ষে বিরোধীদের প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারত।

তা সত্ত্বেও এ বারের নির্বাচনের প্রচারে অস্ত্র হিসাবে সেই শিল্পায়ন অনেকটাই ফিকে। শাসকদল তৃণমূলের বিভিন্ন দেওয়াল লিখনে যে পুরোপুরি উধাও শিল্পায়ন, তার কারণ না হয় বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু, রঘুনাথপুরে শিল্পায়ন না হওয়া নিয়ে তৃণমূলকে বরাবর বিঁধে আসা বিরোধী দল সিপিএমের দেওয়াল লিখনেও শিল্পায়ন অনেকটাই দায়সারা। কেন? বিরোধী শিবির থেকে বলা হচ্ছে, রাজ্যে পালাবদলের পরের দু’টি ভোটে এই শিল্পায়নকে হাতিয়ার করে শাসকদলের বিরুদ্ধে তারা সার্বিক প্রচার করলেও ভোটের ফলে তার কোনও প্রভাব পড়েনি। বরং লোকসভা ও পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের হাতে কার্যত দুরমুশ হয়েছে বিরোধী পক্ষ। বিশেষ করে বামেরা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার আর শিল্পায়ন নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করতে চাইছে না তারা। বরং তৃণমূলের পাঁচ বছরের দুর্নীতি, এলাকার উন্নয়ন না হওয়ার মতো বিষয়গুলিকে প্রচার তুলে আনছে বিজেপি এবং বাম-কংগ্রেস জোট।

তবে শিল্পায়ন নির্বাচনী যুদ্ধে রঘুনাথপুর থেকে হারিয়ে গিয়েছে, সে কথা মানতে রাজি নন রঘুনাথপুরের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য প্রদীপ রায়। তাঁর দাবি, পাড়া প্রচার, পথসভা, কর্মিসভা কিংবা বাড়ি বাড়ি প্রচারে তাঁরা তুলে আনছেন অনেক সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও রঘুনাথপুরে শিল্পায়ন না হওয়ার বিষয়টিকে। প্রদীপবাবুর কথায়, ‘‘শিল্পের জন্য পদযাত্রা শুরু করে সিঙ্গুরে আমাদের নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, আমরাই পারব শিল্প গড়তে। রঘুনাথপুর ঠিক ওই কথাটাই প্রচারে বলছি আমরা।”

তৃণমূলের দেওয়াল লিখনে ব্রাত্য শিল্পায়ন।
তবু সিপিএম এখনও শিল্পের স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।—পৌলমী চক্রবর্তী

শিল্পায়ন ব্রাত্য শাসক-শিবিরের প্রচারেও। শিল্পকে হাতিয়ার করলে নিজেদের মুখ পোড়ার আশঙ্কা থেকেই প্রচারে তা সামনে আনছে না তৃণমূল। জেলা স্তরের একাধিক তৃণমূল নেতা একান্ত আলাপচারিতায় মানছেন, গত বিধানসভা ভোটের পরে রঘুনাথপুরকে রাজ্যে শিল্পের অন্যতম মুখ হিসাবে তুলে ধরার যে ঘোষণা রাজ্য সরকার করছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। শিল্পে এক চুলও এগোয়নি এই অঞ্চল। এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘রঘুনাথপুরে শিল্পায়ন নিয়ে বেশি প্রচার করতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। তাই শিল্পায়নের বদলে প্রচারে জোর দেওয়া হচ্ছে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের উপরে।”

রঘুনাথপুরের বিদায়ী বিধায়ক তথা প্রার্থী পূর্ণচন্দ্র বাউরিও মনে করাচ্ছেন, রঘুনাথপুরে শিল্প না হাওয়ার জন্য তাঁদের দায়ী করে বিরোধীদের সার্বিক প্রচার লোকসভা ও পঞ্চায়েতে প্রত্যাখান করেছেন ভোটাররা। তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে রাজ্যে সার্বিক উন্নয়ন হয়েছে। কন্যাশ্রী, দু’টাকা কেজি দামে চাল, সবুজ সাথী প্রকল্পে সাইকেল দেওয়া থেকে শুরু করে সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরি— সবই দেখেছেন এলাকার বাসিন্দারা। এই সার্বিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে তৃণমূলকে ফের জয়ী করার আহ্বান নিয়েই কর্মীরা প্রচারে নেমেছেন।’’

বিদায়ী বিধায়ক যাই দাবি করুন না কেন, লোকসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে কিন্তু রঘুনাথপুরে খুব স্বস্তিতে নেই শাসকদল। সে বার তৃণমূল বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্র (এর অধীনে রঘুনাথপুরও) থেকে পেয়েছিল ৬১ হাজার ৫৫১ ভোট। বাম ও কংগ্রেসের মিলিত ভোট ধরলে এই কেন্দ্রে তৃণমূল এগিয়ে রয়েছে মাত্র পাঁচশো ভোটে! গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে লোকসভায় এই কেন্দ্রে ভোট কমেছিল তৃণমূলের। ওই ভোট গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে। তারা প্রায় ৪৩ হাজার ভোট পেয়েছিল। এখন বিজেপি-র সেই হাওয়া নেই। ফলে, এ বার বিজেপি-র ওই ভোট ভেঙে কোন পক্ষের ঘরে যাবে, সেই অঙ্কই কষতে ব্যস্ত তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেস জোট। এই তথ্য মাথায় রেখে রঘুনাথপুরে বিজেপি-কে ভাঙাতেও তৎপর হয়েছে তৃণমূল। রঘুনাথপুর পুরসভায় বিজেপির একমাত্র কাউন্সিলর-সহ রঘুনাথপুর ১ ব্লকের বিজেপি-র সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতাদের নিজেদের দিকে টানতে সমর্থ হয়েছে তারা। তৃণমূলের একাধিক নেতার দাবি, লোকসভায় তাদের যে ভোট বিভিন্ন কারণে বিজেপির দিকে চলে গিয়েছিল, তা ফের তৃণমূলে ফিরতে শুরু করেছে। তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে গত বছরের পুরসভা নির্বাচনে।

লোকসভা ভোটের ফলের প্রভাব এ বার হবে না বলেই দাবি তৃণমূলের। তাদের দাবি, রঘুনাথপুর বিধানসভার ফলাফলের অনেকটাই নির্ভর করে রঘুনাথপুর শহরের উপরে। সেখানে পুরসভায় বিজেপি-র মাত্র একটি আসন পেয়েছিল। সিপিএম ও কংগ্রেস মিলিত ভাবেও পুরসভায় তৃণমূলের অর্ধেক আসন পায়। পূর্ণচন্দ্রবাবু বলেন “এই বিধানসভা এলাকার তিনটি পঞ্চায়েত সমিতি আমাদের দখলে। তিন ব্লকের দুই-তিনটি পঞ্চায়েত ছাড়া সবগুলিতেই তৃণমূল ক্ষমতায়। পুরসভাও ১৫ বছর ধরে চালাচ্ছি আমরা। সর্বোপরি আমাদের সরকারের উন্নয়নের কাজ মানুষ দেখেছেন। লোকসভার ভোটের হিসাব কষে বিরোধী জোট রঘুনাথপুরে জেতার দিবাস্বপ্ন দেখছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Industrial belt campaign
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE