Advertisement
১৭ মে ২০২৪
উদ্বোধনের আগেই অনিশ্চিত সরকারি পান্থশালার ভবিষ্যৎ

দূষণের চোটে বাড়া ভাতে ছাই

ছুটি পেলেই খোলা প্রকৃতির মধ্যে গিয়ে হাঁফ ছে়ড়ে বাঁচতে চায় শহুরে বাঙালি। কিন্তু খোদ সরকারি পান্থশালার জানালা খুললে যদি দূরের টিলা ঢাকা পড়ে যায় গা ঘেঁষে থাকা কারখানার উদ্ধত চিমনিতে? ঘরময় থিকথিক করে কালো কয়লার গুঁড়ো? এমন দুঃস্বপ্নই একেবারে হাতেনাতে সত্যি হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়ার আঘরপুরে। আঘরপুর ডুংরি।

মেঝের আসল রঙ চাপা পড়েছে ছাইয়ে। মুখ ধোয়ার বেসিনেরও একই হাল। ছবি: সুজিত মাহাতো

মেঝের আসল রঙ চাপা পড়েছে ছাইয়ে। মুখ ধোয়ার বেসিনেরও একই হাল। ছবি: সুজিত মাহাতো

প্রশান্ত পাল
জয়পুর শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০১:০১
Share: Save:

ছুটি পেলেই খোলা প্রকৃতির মধ্যে গিয়ে হাঁফ ছে়ড়ে বাঁচতে চায় শহুরে বাঙালি। কিন্তু খোদ সরকারি পান্থশালার জানালা খুললে যদি দূরের টিলা ঢাকা পড়ে যায় গা ঘেঁষে থাকা কারখানার উদ্ধত চিমনিতে? ঘরময় থিকথিক করে কালো কয়লার গুঁড়ো? এমন দুঃস্বপ্নই একেবারে হাতেনাতে সত্যি হয়ে গিয়েছে পুরুলিয়ার আঘরপুরে।

আঘরপুর ডুংরি। সবুজ গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে কালো রাস্তা। দিগন্তে জেগে ছোট ছোট টিলা। আঁকাবাঁকা আলপথ সেখানে গিয়ে মিশেছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ‘উত্তরা’ ছায়াছবির শ্যুটিং-এ অঘোরপুরে তাঁবু ফেলেছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। গৌতম ঘোষ, অঞ্জন দাশ, রাজ চক্রবর্তী-সহ অনেক পরিচালকের চলচ্চিত্রের পটভূমিতে ধরা রয়েছে আঘরপুরের প্রকৃতি।

সেই সবুজ প্রকৃতির উপরে পড়েছে দূষণের থাবা। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ধারে মোট পাঁচটি পান্থশালা গড়ে তুলেছে রাজ্য সরকার। নাম দেওয়া হয়েছে পথসাথি। লম্বা সফরের মাঝে যাত্রীরা যাতে জিরিয়ে নিতে পারেন, সে জন্যই এই উদ্যোগ। আঘরপুরের পথসাথিটি রয়েছ পুরুলিয়া-রাঁচি রাজ্য সড়কের পাশে। অদূরেরই চাষমোড়। সেখানে এই রাস্তার সঙ্গে মিশেছে পুরুলিয়া-বোকারো-ধানবাদ (৩৪ নম্বর) জাতীয় সড়ক।

প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, পান্থশালাটি নির্মাণের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা। নির্মাণের কাজ শেষ। জেলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বনিযুক্তি প্রকল্প দফতরের আধিকারিক অমল আচার্য জানান, পান্থশালা পরিচালনার জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে হরেক কিসিমের রান্না থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়নের কায়দা কানুন শেখানোও শুরু হয়েছে। কিন্তু এতো আয়োজনের সমস্তটাই জলে যেতে বসেছে। পান্থশালা লাগোয়া কয়লা কারখানা থেকে কয়লার গুঁড়ো আর ছাই উড়ে এসে ঘরগুলি নোরংা করে ফেলেছে।

নির্মাণকারী সংস্থার কর্মী প্রীতম সামন্ত থেকে শুরু করে পান্থশালা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্বনির্ভর দল ‘সম্পূর্ণা পরিষেবা সমবায়’-এর সদস্যরা— সবাই সরব হয়েছেন ওই দূষণের বিষয়টি নিয়ে। ওই দলের সদস্য বুলু দত্ত, সরস্বতী মাহাতোরা বলেন, ‘‘বারান্দা কালো হয়ে থাকছে। এমনকী দরজা বন্ধ করে রাখলেও ঘরের ভিতর কালোগুঁড়ো ঢুকে যাচ্ছে।’’ শীতলা মাহাতো নামে আর এক সদস্যের মন্তব্য, ‘‘এই পরিবেশে রান্না করা খাবারদাবার বা জল রাখাও মুশকিল। বাড়া ভাতে সত্যিকারের ছাই পড়ে যাবে।’’ স্বনিযুক্তি প্রকল্প দফতরের আধিকারিক অমলবাবু বলেন, ‘‘পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্বনির্ভর দলটির থেকে দূষণের বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ পেয়েছি। জেলাশাসককে পুরো ব্যাপারটা জানানো হবে।’’

কিন্তু ওই কারখানার পাশেই কেন তৈরি হল পান্থশালা? প্রশাসনের আধিকারিকদের দাবি, ওই এলাকায় সরকারি খাস জমি পাওয়া যাচ্ছিল না। শুধু কারখানার পাশের জায়গাটুকুই পড়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে সেখানেই পান্থশালা গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু, ওই কারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা অকেজো করে রাখার ফলেই এই সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে তাঁদের দাবি। প্রশাসনের এক কর্তার মতে, দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র চালাতে খরচ বে়ড়ে যায় বলে সেটি বন্ধ করে রেখে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। পান্থশালা গড়ে ওঠার পরে দূষণের ব্যাপারটা সরাসরি চোখে পড়েছে।

সম্প্রতি এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ঝাঁ চকচকে দোতলা পান্থশালার মেঝে থেকে শুরু করে জানালার কাচ, দরজা এমনকি হাত-মুখ ধোওয়ার বেসিন— সর্বত্র কয়লা আর ছাইয়ের পুরু স্তর পড়ে গিয়েছে। হাত বোলালেই আঙুলে কালো হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, কাঁচা কয়লা পুড়িয়ে জ্বালানি কয়লা তৈরি করা হয় ওই কারখানায়। স্থানীয় উপরকাহান গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অনন্ত কর্মকার কারখানা থেকে এলাকায় দূষণ ছড়ানোর বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘দূষণে গাছপালা কালো হয়ে যাচ্ছে।’’ তবে বিষয়টির প্রশাসনের দেখার কথা বলে তাঁর দাবি। জেলা পরিষদের পরিবেশ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘কোনও কারখানাই এ ভাবে দূষণ ছড়াতে পারে না। দূষণ বন্ধ করা না গেলে কারখানা বন্ধ করতে হবে।’’

কিন্তু যে কারখানাটিকে ঘিরে সমস্ত অভিযোগ, সেটির কর্তৃপক্ষ সমস্ত দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন। কারখানার এক পদস্থ কর্মী শিবম সিংহের দাবি, বাজার নেই বলে কারখানা প্রায় বছর খানেক ধরে বন্ধ। তাই চিমনি থেকে কালো ধোঁয়া বেরোনোর প্রশ্নই নেই। শিবমবাবু বলেন, ‘‘কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র রয়েছে। তবে হওয়ায় যদি কয়লার গুঁড়ো বা ছাই ওড়ে সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

INN Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE