Advertisement
E-Paper

নিশুতি রাতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল ওরা

শীতের রাত। নিঝুম গোটা তল্লাট। দরজায় খিল এঁটে শুয়ে পড়েছেন গ্রামের অনেকেই। তখনও জেগে হরেন বাস্কে। বাড়ির উঠোনে উনুনে ভাতের হাঁড়ির পাশে বসে হাত সেঁকছিলেন সিপিএমের স্থানীয় ওই নেতা।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০১৬ ০৩:৫২
চার্জশিট দিলেও পুলিশ প্রমাণ দিতে পারেনি। কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ নিহত নেতার স্ত্রী শ্যামলী বাস্কে।

চার্জশিট দিলেও পুলিশ প্রমাণ দিতে পারেনি। কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ নিহত নেতার স্ত্রী শ্যামলী বাস্কে।

• বারিকুলের শুঁড়িতাড়ি গ্রামে ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি খুন হন সিপিএম নেতা হরেন বাস্কে।

• রাতে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জঙ্গলে তাঁকে গুলি করে খুন করে আততায়ীরা।

• পরিবার ও সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, মাওবাদীরা তাঁকে খুন করে।

• পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু চার্জশিটে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে না পারায় ধৃতেরা জামিন পেয়ে যায়।

শীতের রাত। নিঝুম গোটা তল্লাট। দরজায় খিল এঁটে শুয়ে পড়েছেন গ্রামের অনেকেই। তখনও জেগে হরেন বাস্কে। বাড়ির উঠোনে উনুনে ভাতের হাঁড়ির পাশে বসে হাত সেঁকছিলেন সিপিএমের স্থানীয় ওই নেতা। হঠাৎই সদর দরজা ঠেলে এক অপরিচিত যুবকের কণ্ঠস্বর— ‘‘বৌদি, হরেনদা আছে না কি?’’ উনুনের পাশ থেকেই সাড়া দিয়েছিলেন ওই নেতা। তাঁকে বাড়ি থেকে ডেকে গ্রামের শেষপ্রান্তে নিয়ে যায় জলপাই পোশাকের জনা পাঁচেক যুবক। আধঘণ্টা পরে বাড়ির পিছনে জঙ্গলের দিক থেকে শুধু দু’টি গুলির শব্দ শোনা গিয়েছিল। উৎকণ্ঠা নিয়ে অনেক রাতে বাড়ির লোকেরা গিয়ে দেখেন, মাটিতে পড়ে গুলিবিদ্ধ হরেন বাস্কের (৩৮) দেহ।

এখন ওই এলাকার পট বদলে গিয়েছে। কিন্তু জঙ্গলমহলের সেই সব অশান্ত দিনের কথা এখনও ভুলতে পারেন না বাসিন্দারা। দিনটা ছিল ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি। রাত প্রায় ৮টা। শুঁড়িতাড়ি গ্রামের বাসিন্দা সিপিএম সদস্য তথা ডিওয়াইএফ-এর রাওতোড়া লোকাল কমিটির সম্পাদক হরেনবাবুকে ডেকে নিয়ে আততায়ীরা। পুলিশ ও সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, মাওবাদীরা তাঁকে খুন করেছিল। নিহতের ভাই ধীরেন বাস্কে পরেরদিন বারিকুল থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। এফআইআর-এ অজ্ঞাত পরিচয় কয়েক জনের বিরুদ্ধে খুনের মামলা রুজু হয়। যার কেস নম্বর ০১/২০১০।

তদন্তে নেমে পুলিশ দাবি করে, খুনের পিছনে রয়েছে মাওবাদীদের বারিকুল স্কোয়াড। ধীরে ধীরে পুলিশ ওই খুনের ঘটনায় যুক্ত অভিযোগে মাওবাদী নেতা কিঙ্কর পাল, গোবিন্দ সিং সর্দার-সহ পাঁচজনকে ধরে।

পেশায় দিনমজুর হরেনবাবু দলের দক্ষ সংগঠক ছিলেন। রাজনৈতিক কারণেই তাই তাঁকে মাওবাদীরা টার্গেট করেছিল বলে অভিযোগ সিপিএম নেতৃত্ব এবং তাঁর পরিবারের। তদন্তে নেমে পুলিশ এই খুনের পিছনে মাওবাদী নেতা কিঙ্কর পাল-সহ কয়েকজন পলাতক স্কোয়াড সদস্য জড়িত বলে জানতে পারে।

তবে ওই ঘটনার পরে হরেনবাবুর খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে বেলপাহাড়ির গিদিঘাটি ও নেগুড়িয়া থেকে তিনজনকে পুলিশ ধরে। পরে কিঙ্কর পাল, গোবিন্দ সিং সর্দারকেও গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁকে খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত একটি বন্দুক উদ্ধার হয়।

কিন্তু ঘটনার প্রায় দু’বছর পরে পুলিশ যখন আদালতে চার্জশিট জমা দেয়, জানা গিয়েছে ধৃতদের বিরুদ্ধে খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার সরাসরি কোনও প্রমাণ দেখাতে পারেনি তারা। পরে কিঙ্কর পাল-সহ ধৃত পাঁচজনই জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। অন্যান্য সব ঘটনার মতো ওই খুনের ঘটনাতেও তিনি কোনও ভাবেই যুক্ত নন বলে দাবি করেছেন বারিকুল থানার হিজলি গ্রামের বাসিন্দা কিঙ্কর পাল।

বছর দুয়েক আগে নিহত নেতার বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বামীর অবর্তমানে সংসারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন স্ত্রী শ্যামলীদেবী। কিন্তু কাজের ফাঁকে তাঁ মনে এখনও হানা দেয় সেই দুঃস্বপ্নের রাত।

চোখ মুছতে মুছতে তিনি বলে চলেন, “বড় মেয়ে বারিকুলে ও ছোট মেয়ে চাতরি স্কুলের হস্টেলে থেকে পড়ত। সে দিন দুই মেয়ে বাড়িতে ছিল না। রাতে অপরিচিত এক যুবক খালি হাতেই শুধু বাড়িতে এসেছিল। আমার মনে হয়, স্বামী তাকে চিনত। তবে আমি তাকে চিনি না। তার ডাক শুনে স্বামী নিজেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি বারণ করার সেই সুযোগটুকুও পাইনি।’’

তাঁর দাবি, রাজনীতি করলেও হরেনবাবু কোনওদিন কারও ক্ষতি করেননি। গ্রামের সবাই তাঁকে ভালবাসতেন। সে কারণেই বোধহয় মাওবাদীরা তাঁকে খুন করল।” নিহতের ভাই ধীরেনবাবুর গলায় ক্ষোভ, দাদার খুনিদের পুলিশ সাজা দিতে পারল না। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া গেলেও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে থেকে ক্ষতিপূরণ বা চাকরি কিছুই দেওয়া হল না। উল্টে মাওবাদীরাই চাকরি, পুনর্বাসন প্যাকেজ পাচ্ছে!’’

এক ছটাক জমিও নেই। দিনমজুরি করে সংসার চালানো শ্যামলীদেবীর চোয়াল তবু শক্ত। বলছেন, ‘‘খুনিদের চরম সাজা দিতেই হবে। জীবনের বাকি দিনগুলো সেই অপেক্ষায় থাকব।’’

Jangalmahal Maoist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy