Advertisement
E-Paper

বিকল্প চাষের দিশারী সব্জি হাট

‘দূরে দূরে গ্রাম দশ বারো খানি, মাঝে একখানি হাট’। সেই একটি হাটই এলাকার বেশ কিছু গ্রামকে সব্জি চাষে উৎসাহ দিচ্ছে ময়ূরেশ্বর। আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর ছক ভেঙে, এলাকায় অনেকখানি উন্নয়নও ঘটিয়ে ফেলেছে। গতানুগতিক ধান, গম কিংবা আলুর পরিবর্তে সব্জি চাষ করে বাড়তি দু’পয়সা ঘরে তুলতে পারছেন গাঁ-ঘরের চাষিরা!

অর্ঘ্য ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৫ ০২:০৪
বাড়ির পাশে হাট। সেই হাটই জমে উঠেছে এলাকার গ্রামের বিকিকিনিতে। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

বাড়ির পাশে হাট। সেই হাটই জমে উঠেছে এলাকার গ্রামের বিকিকিনিতে। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

‘দূরে দূরে গ্রাম দশ বারো খানি, মাঝে একখানি হাট’।
সেই একটি হাটই এলাকার বেশ কিছু গ্রামকে সব্জি চাষে উৎসাহ দিচ্ছে ময়ূরেশ্বর। আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোর ছক ভেঙে, এলাকায় অনেকখানি উন্নয়নও ঘটিয়ে ফেলেছে। গতানুগতিক ধান, গম কিংবা আলুর পরিবর্তে সব্জি চাষ করে বাড়তি দু’পয়সা ঘরে তুলতে পারছেন গাঁ-ঘরের চাষিরা!
একদিন মোটা ভাত কাপড়ের যোগাড় করতে হিমসিম খেতে হয়েছে যাদের, বছর কয়েকের মধেই সেই সব চাষিদের বাড়িতে বসছে নলকূপ, খড়ের পরিবর্তে ঘরের চালে চেপেছে টিন, বেড়েছে ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর প্রবণতাও। চাষিদের এ হেন আর্থিক উন্নয়নের পিছনে অনুঘটকের কাজ করে চলেছে ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া সব্জি হাট।
কয়েক বছর আগেও এলাকায় সব্জি চাষ হলেও তা নিজেদের বাড়িতে খাওয়ার জন্যই হত। সেও সামান্য জমিতে করতেন চাষিরা। মূলত বাজার জনিত সমস্যার কারণেই বড় করে সব্জি চাষের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেতেন না তারা। কারণ একসময় কাছাকাছি ৫/৬ কিমির মধ্যে কোনও সবজি হাট ছিল না। সব্জি নিয়ে দূরের ওইসব হাটে গিয়ে চরম সমস্যায় পড়তেন চাষিরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেরিতে পৌঁছোনোর কারণে ভাল দাম পেতেন না। তখন আড়তদার কিংবা ব্যবসায়ীদের মর্জি মাফিক দামে সব্জি বিক্রি করে বাড়ি ফিরতে হত তাঁদের। সেক্ষেত্রে চাষের খরচটুকুও উঠত না। এতে সম্ভবনা থাকা স্বত্ত্বেও সব্জি চাষ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন চাষিরা। বছর পনের আগে থেকে ছবিটা বদলে যায়। ওইসব চাষিদেরই সব্জি চাষে ফেরাতে শুরু করে ওই হাট।
কেমন করে সম্ভব হল হাটের এই অর্থকরী উদ্যোগ?
২০০০ সালে স্থানীয় ধর্মরাজতলা চত্বরে সপ্তাহে ২ দিন সব্জি হাট বসানোর উদ্যোগ নেয় ধর্মরাজ সংঘ। তারপর থেকেই এলাকায় সবজি চাষের প্রবণতা বাড়ে বলে উদ্যোক্তাদের দাবি। একই দাবি, চাষিদেরও। ১৭ কাঠা জমি রয়েছে ঢেকার অজিত বাগদির। একসময় ওই জমিতে ধান-গমের মতো গতানুগতিক চাষের পাশাপাশি দিনমজুরি করেও ভালভাবে ৪ সদস্যের দুবেলা দু’মুঠো ভাত জুটত না। অর্থাভাবে দুই ছেলেকে মাধ্যমিকের গণ্ডী পার করতেও পারেননি। লোকপাড়ায় সব্জি হাট হওয়ার পর অজিতবাবুর ছোট ছেলে প্রশান্ত ১০ কাঠা জমি ধান গমের চাষের জন্য রেখে বাকি ৭ কাঠা জমিতে সারা বছর বিভিন্ন ধরণের সব্জি শুরু করেন। ইতিমধ্যেই তাঁদের বাড়িতে রঙিন টিভি এসেছে। কিনেছেন তিনটি গাই, জল তোলার মেসিন। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮। তাদের মধ্যে দু’জন নিয়মিত স্কুলে যায়।

এই সমৃদ্ধিই বলে দেয় অজিতবাবুর বাড়িতে আর অনটন নেই। তাঁর দাবি, ‘‘সব্জি চাষের জন্যই এসব সম্ভব হয়েছে। গতানুগতিক চাষ করে সবসময় খরচটুকু পর্যন্ত ওঠত না। এখন হাজার আটেক টাকা খরচ করে ৭ কাঠা জমিতে সব্জি চাষ করে ৪০ হাজার টাকারও বেশি আয় হয়।’’

একই দাবি ওই গ্রামেরই রাখহরি মণ্ডল, ল’বেলেড়ার রবীন্দ্রনাথ পাল, ডাঙ্গাপাড়ার নারায়ণ মণ্ডলদেরও। দু’ বিঘে ৫ কাঠা জমির মালিক রাখহরিবাবু ৩০০০ টাকা খরচ করে সেই জমিতে ধান, গম কিংবা সরষে চাষে ৭০০০ টাকাও পেতেন না। এখন ১৫ হাজার টাকা খরচ করে ২৫ কাঠা জমির সব্জি চাষ থেকেই বছরে তাঁর ৫০/৫৫ হাজার টাকা উঠে আসে। ওই আয়েই তাঁর খড়ের চালের বাড়ি পাকা হয়েছে। কিনেছেন ১২ কাঠা জমিও।

অন্যদিকে ২ বিঘে জমির মালিক রবীন্দ্রনাথবাবু ১০ কাঠা জমিতে সব্জি চাষ করে ইতিমধ্যেই বাড়িতে টিউবওয়েল বসিয়েছেন, খড় নামিয়ে ঘরের চালে টিন দিয়েছেন। তারা বলেন, ‘‘কাছাকাছি হাট না থাকায় এতদিন আমরা সেভাবে সব্জি চাষ করতে পারিনি। কারণ, দূরের হাটে সব্জি নিয়ে যেতে হয়রানির একশেষ হত। ন্যায্য দাম না পেলেও ফের হয়রানির জন্য আড়তদার কিংবা ব্যবসায়ীদের মর্জিমাফিক দামেই বিক্রি করে দিয়ে আসতে হত। আর বাড়ির কাছের হাটে চাহিদা দেখে সেই অনুযায়ী সব্জি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ মেলে। সময় নষ্ট করে যাতায়াতের ঝক্কিও পোহাতে হয় না।’’

সব্জি চাষের সব থেকে বড়ো সুবিধা হল একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া চাষিদের মার খাওয়ার আশঙ্কা নেই। সে কথাই বলছিলেন ঢেকার চণ্ডী মণ্ডল, তিলডাঙ্গার গৌরাঙ্গ ভল্লারা। বলেন, ‘‘দাম দরের হেরফের যাই হোক না কেন, কমবেশি লাভের পয়সা চাষির ঘরে ঢোকেই। তাছাড়া পতিত ডাঙা জমিতেও সব্জি চাষ করা যায়।’’

শুধু সব্জি চাষই নয়, ওই হাটকে কেন্দ্র করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন অন্য ব্যবসায়ীরাও। হাট পরিচালন সমিতি সূত্রেই জানা গিয়েছে, ৬০ জন সব্জি বিক্রেতার পাশাপাশি ওই হাটে এখন ১৫ জন মাছ বিক্রেতা, ৭ জন ফল বিক্রেতা-সহ প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ী রুটিরুজির জায়গা খুঁজে পেয়েছেন। দৈনিক প্রায় লক্ষাধিক টাকার লেনদেন হয়। হাট পরিচালন সমিতির অন্যতম কর্ণধার অজিত ধীবর, মিহির কোনাইরা বলেন, ‘‘শুধু আর্থিক লেনদেনই নয়, ওই হাটের আয় থেকেই বাৎসরিক ধর্মরাজ পুজো, খেলাধুলো-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যয়ও চলে।’’

হাটকে কেন্দ্র করে এলাকার অর্থনীতি চাঙা হওয়াকে কেমনভাবে দেকছেন স্থানীয় প্রধান?

সংশ্লিষ্ট ঢেকা পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের মিঠু গড়াই বলেন, ‘‘সত্যিই ওই হাট চালু হওয়ার পর থেকেই এলাকায় সব্জি চাষের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাটকে কেন্দ্র করে আর্থসামাজিক পরিকাঠামোরও উন্নয়ন ঘটেছে। আমরা ইতিমধ্যেই ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে হাট চত্বরে মাটি ভরাট এবং পাইপ লাইনের জলের ব্যবস্থা করেছি। আরও কিছু উন্নয়নেরও চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।’’

arghya ghosh mayureswar veg market mayureswar lokpara farmer families veg productions
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy