যুদ্ধজয়ী: যুবরাজের সঙ্গে শীলা। নিজস্ব চিত্র
এক বছর আগে প্রথম পুরুলিয়া শহরে এসেছিল শীলা। জয়পুরের খেদাটাঁড় গ্রাম থেকে জেলা সদরের দূরত্বটা বেশি নয়। কিন্তু সেটুকু পার করতেই ১৩ বছর কাবার হয়ে গিয়েছিল। সেই মেয়ে ক’দিন আগে ঘুরে এল কলম্বো। ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে দেশ-বিদেশের মানুষকে শোনাল তার লড়াইয়ের গল্প।
শীলা বাগদি। গতবার কন্যাশ্রী কাপ ফুটবলে ১৮টি গোল করে সবার নজর কেড়েছিল জয়পুর আরবিবি হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রীটি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল ও ইউনিসেফ-এর যৌথ উদ্যোগে অনূর্ধ্ব ১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রচারে একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে সে ছিল দেশের অন্যতম প্রতিনিধি। ইউনিসেফ-এর অ্যাডোলেসেন্ট ইন্টারভেনশন কর্মসূচির পুরুলিয়ার নোডাল অফিসার অনিরুদ্ধ রায় বলেন, ‘‘আগামী জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডে অনূর্ধ ১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা হবে। তারই প্রচার কর্মসূচি ছিল কলম্বোয়। দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা আর ভারত থেকে প্রতিনিধিরা গিয়ে তাদের লড়াইয়ের কথা শুনিয়েছে সেখানে। ভারত থেকে গিয়েছিল শীলা আর ঝাড়খণ্ডের এক কিশোরী।’’
বাবা মতিলাল বাগদি ঝা়ড়খণ্ডের একটি মেসে রাঁধুনির কাজ করেন। এক জনের আয়ে ছ’জনের সংসার চলে না। মা বড়কি বাগদিকেও দিনমজুরি করতে হয়। দুপুরে স্কুল আর বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা, কুমির ডাঙা খেলে দিন কাটছিল শীলার। তার মধ্যেই জয়পুরে হয় জঙ্গলমহল কাপ প্রতিযোগিতা। শীলা তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। সালটা ২০১৩। মাঠে মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখে ভাবনার দুনিয়াটাই বদলে যায় কিশোরীটির।
তখনও কন্যাশ্রী ফুটবলের নাম শোনেননি কেউ। বান্ধবী পিঙ্কি বাগদি, মমতা বাগদি, প্রিয়া বাগদিদের সঙ্গে শলা করে শীলা যায় জগন্নাথ বাগদির কাছে। জগন্নাথ গ্রামের ছেলেদের ফুটবল শেখান। শখেই। ছোটছোট মেয়েদের আগ্রহ দেখে তিনিই ফুটবলের বন্দোবস্ত করে দেন। শুরু হয় প্রশিক্ষণ। বছর পঁয়ত্রিশের জগন্নাথ বলেন, ‘‘মেয়েরা মাঠে ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি করছে, ব্যাপারটা সেই সময়ে অনেকেই ভাল চোখে দেখতেন না। কিন্তু চোখকান বুঁজে ওরা ফুটবলে ডুবেছিল।’’ অবশ্য পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল জয়পুর থানার পুলিশ। তৈরি হয় ‘খেদাটাঁড় মহিলা ফুটবল ক্লাব’।
তারপর আসে কন্যাশ্রী ফুটবল কাপ। গত বছর পুরুলিয়ায় সেই প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন হয় জয়পুর কন্যাশ্রী ক্লাব। চ্যাম্পিয়ন দলের ক্যাপ্টেন শীলা নিজে পায় প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান। জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘এটা কন্যাশ্রী কাপের সাফল্য বলতে পারেন। একেবারে গল্পের মত। এই কাপ না থাকলে তো শীলা নজরেই পড়ত না। ও এখন দেশের মুখ।’’
যুবরাজ সিংহের সঙ্গে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন? শীলা বলে, ‘‘আমি তো এতদিন ছবিতেই দেখেছি ওঁকে। প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না আমার সামনে সেই মানুষটাই দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু উনি আমার কথা মন দিয়ে শুনেছেন। বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করেছেন।’’
মেয়ের পাসপোর্ট আর ভিসা করাতে প্রথম কলকাতায় পা দেন শীলার বাবা মতিলালবাবু। তিনি বলেন, ‘‘আমি মেয়েটাকে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাব সেই সামর্থ্য নেই। ও-ই আমাকে কলকাতা ঘুরিয়ে আনল। ওই দিনটায় চোখে জল এসে গিয়েছিল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy