এক দিকে নিরাপত্তা বাড়ানো। অন্য দিকে রেফারের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা।
এই দুই পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই রামপুরহাট জেলা হাসপাতালে রোগীর পরিজনদের সাম্প্রতিক অসহিষ্ণু হয়ে পড়ার ঘটনায় লাগাম পরাতে চায়ছে প্রশাসন। একই লক্ষ্যে আরও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও ভাবা হয়েছে। শুক্রবার এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাসের ডাকা জরুরি বৈঠকে পরিস্থিতির মোকাবিলায় এমনই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হাসপাতালের সুপার সুবোধকুমার মণ্ডল, রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার সুস্মিত চট্টোপাধ্যায়, রামপুরহাট ‘স্বাস্থ্যজেলা’র ডেপুটি সিএমওএইচ-২ স্বপন ওঝা, এসডিপিও (রামপুরহাট) কমল বৈরাগ্য এবং রামপুরহাট, মাড়গ্রাম ও তারাপীঠ থানার আধিকারিকেরা।
গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার— এই তিন দিন ধরে ওই হাসপাতালে রোগীর পরিজনদের হাতে স্বাস্থ্যকর্মীরা নিগৃহীত হয়েছেন। চিকিৎসক, নিরাপত্তা কর্মী, ওয়ার্ড মাস্টার— কেউ-ই বাদ যাননি। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের নিরাপত্তা আঁটোসাটো করাকেই অন্যতম দাওয়াই বলে মনে করছেন আশিসবাবুরা। এসডিও অফিসে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা ওই বৈঠকের শেষে এ দিনও মন্ত্রী অভিযোগ করেন, ‘‘এই হাসপাতালে উন্নত পরিষেবা চালু আছে। কিছু দিন পরেই হাসপাতাল মেডিক্যাল কলেজের তকমা পাচ্ছে। অথচ এক শ্রেণির মানুষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে চক্রান্ত করে হাসপাতালে গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করছে।’’
বেশ কয়েকটি কড়া পদক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এ দিনের বৈঠকে। এক, হাসপাতালের মূল ভবনের বেশ কিছু জায়গায় সিসিটিভি বসানো হবে। নিগ্রহের কোনও ঘটনা ঘটলে সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। দুই, দুর্ঘটনার কেসে পুলিশ আধিকারিকেরা হাসপাতাল সুপারের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করবেন। তাতে হাসপাতালে অ্যাক্সিডেন্টের কেসে ভর্তি হওয়া রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে। তিন, ‘ডিউটি আওয়ার্সে’ চিকিৎসকদের হাসপাতালে থাকা বাধ্যতামূলক। চার, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হাসপাতাল চত্বরে শীঘ্রই ২৪ ঘণ্টার জন্য একটি পুলিশ ক্যাম্প থাকবে। পাঁচ, জেলা হাসপাতাল থেকে রোগীদের রেফার করে দেওয়ার প্রবণতা কমাতে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে কমাতে হবে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে রেফারের সংখ্যাও। ছয়, দালাল চক্র রুখতে হাসপাতালে ডিউটি আওয়ার্সে চিকিৎসকদের সঙ্গে বহিরাগতদের দেখা গেলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাঝে মাঝেই পুলিশ-প্রশাসন অভিযানও চালাবে। আশিসবাবু বলেন, ‘‘এই পরিকল্পনাগুলি দ্রুত বাস্তবায়িত করা হবে। পাশাপাশি হাসপাতালে চিকিৎসক, কর্মীদের শূন্যপদ পূরণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলব।’’ সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করা গেলে হাসপাতালের ছবিটা অনেকটাই বদলে যাবে বলে আশা সুপ্রিয়বাবুরও।
যদিও ওই সিদ্ধান্তগুলি কতটা কার্যকর করা যাবে, প্রাথমিক ভাবে তা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এই জেলা হাসপাতালে লোকবলের অভাব না মিটলে, বর্তমান ছবিটা কতটা পাল্টাবে— তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকদের অনেকেই। জরুরি বিভাগে আরও কয়েক জন অন ডিউটি মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগের দাবি তুলে এ দিন বৈঠক শেষে মন্ত্রীর সামনেই সাংবাদিকদের সুপার যেমন বলেন, ‘‘দাবি মতো ‘অন কল’ চিকিৎসকদের ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে রাখার মতো পরিকাঠামো এখন এই হাসপাতালে নেই।’’ অবশ্য মেডিক্যাল কলেজ হয়ে গেলে তা দূর হয়ে যাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এরই পাশাপাশি পরিকাঠামো এবং চিকিৎসক-কর্মীদের অভাব নিয়ে ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি কোন অদৃশ্য জাদুবলে দুম করে রোগীদের রেফার করা কমিয়ে দেবে, তার সদুত্তরও মেলেনি। একই ভাবে জেলা হাসপাতাল নিজেও কীভাবে রেফারের সংখ্যা কমাবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। অন্য দিকে, অনিশ্চয়তা রয়েছে হাসপাতাল চত্বরে ২৪ ঘণ্টার পুলিশ ক্যাম্প নিয়েও। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘মন্ত্রী বলে দিলেই তো আর হয় না! আগে জেলার পুলিশ সুপারের কাছে অনুমতি চাইতে হবে। সেই অনুমতি না মেলা পর্যন্ত কিছু করা যাবে না।’’
এ দিকে, এ দিনের বৈঠকে চিকিৎসক বা হাসপাতালের কর্মীদের কাউকে ডাকা হয়নি। তা নিয়ে একাংশের মনে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, চিকিৎসক ও কর্মীরাই হাসপাতালের ‘রোগ’ ও ‘প্রতিকার’গুলিকে ঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারতেন। যদিও নিগৃহীত চিকিৎসক হীরককান্তি দাস বলছেন, ‘‘পদক্ষেপগুলি প্রয়োজনীয় ছিল। আশা করি, তা কার্যকর হলে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও পাল্টাবে। তবে, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আরও চিকিৎসক নিয়োগ না করলে প্রধান সমস্যার সমাধান হবে কি?’’ ভর্তি রোগীদের মধ্যে দুর্ঘটনার কেস বেশি থাকায় তিনি হাসপাতালে অবিলম্বে একটি পৃথক ট্রমা কেয়ার সেন্টার চালুর প্রস্তাব দিয়েছেন। অন্য দিকে, আর এক নিগৃহীত চিকিৎসক আশিস সাহার প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই সব পদক্ষেপে হয়তো কিছুটা পরিস্থিতি বদলাবে। তবে, যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হল, আতঙ্কে আছি। চাকরি আর করব কিনা চিন্তাভাবনা করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy