দুবরাজপুরে পারুলিয়ায় এক বাসিন্দার পাকা বাড়ি, নিকোনো উঠোন। উঠোনে ধানের গোলা। ঠিক তার পাশে দিব্যি মাথা তুলেছে ইন্দিরা আবাস যোজনার পাকা নির্মাণ!
দুবরাজপুরেই বনহরি গ্রাম। এক মহিলার নামে ইন্দিরা আবাসের বাড়ি এসেছিল। সেই বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনি দু’কিস্তিতে টাকাও পেয়ে গিয়েছেন। অথচ একটি ইটও গাঁথা হয়নি! কোথাও আবেদন নিবেদন করেও মেলেনি বাড়ি। তো কোথাও স্রেফ শাসকদল ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে একই পরিবারে মিলেছে পৃথক পৃথক তিনটি প্রকল্পের বাড়ি! কোথাও প্রকল্পের জন্য প্রাপ্য ৭০ হাজার টাকার মধ্যে হাজার বিশেক টাকা ঢুকেছে পঞ্চায়েত সদস্যের পকেটে! জেলাজুড়ে ইন্দিরা আবাস যোজনায় নাকি এটাই দস্তুর!
দারিদ্রসীমা নিচে বসবাসকারি গৃহহীনদের মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে দেওয়া ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে যে সরকারি আবাসন প্রকল্প, সেই ইন্দিরা আবাস যোজনা নিয়ে এমন অনেক বেনিয়েমের অভিযোগ এ রাজ্যের বিভিন্ন পঞ্চায়েত এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায়। ব্যতিক্রম নয় এ জেলাও। এমন অভিযোগও রয়েছে যাঁরা প্রকৃত দাবিদার তাঁদের বঞ্চিত করে এমন অনেকে সরকারি ওই প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন তাঁরা উপভোক্তা হওয়ার যোগ্যই ছিলেন না। অভিযোগের সত্যতা মানছেন প্রশাসনের কর্তারও।
ইন্দিরা আবাস প্রকল্পই এখন বদলে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা।
প্রাপকদের সূচকেও বেশ কিছু রদবদল হয়েছে। বেনিয়মের ছবিটা কী এবার কিছুটা বদলাতে চলেছে?
সরকারি আধিকারিক থেকে গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধানদের ব্যক্তিগত অভিমত, ছবিটা কিছুটা হলেও বদলাবে। কারণ দুটি— এক, যে ভাবে প্রকল্পের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে তাতে অনিয়মের সম্ভবনা কম। দুই, তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিরা সরকারি ওই প্রকল্পে বাড়ি পাওয়ার যোগ্য কিনা তা যাচাই করতে তালিকাভূক্তদের নাম ধরে গ্রাম সংদসসভায় আলোচনায় গুরত্ব দেওয়া। জেলায় এখন প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে সেই প্রস্তুতিই চলছে। সম্প্রতি দুবরাজপুরের প্রতিটি পঞ্চায়েত সদস্য ও প্রধানদের ডেকে এই নিয়ে একটি সচেতনতা বৈঠক করছে ব্লক প্রশাসন।
চলতি বছরের মার্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ক্যাবিনেট মিটিংয়ে গ্রামীণ এলাকায় গৃহহীনদের জন্য জন্য এই আবাসন প্রকল্পের নাম ঘোষণা করেন। এই প্রকল্পেরই নাম ছিল ইন্দিরা আবাস যোজনা, রাজীব গাঁধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিপিএল তালিকাভুক্ত গৃহহীনদের জন্য এই প্রকল্প শুরু হয়। ১৫ সালে শহরাঞ্চলে গৃহহীনদের জন্য অনুরূপ একটি অবাসন প্রকল্প ঘোষিত হয়েছে— ২০২২ সালের মধ্যে সকলের জন্য ঘর। এই প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ আবাসন প্রকল্পও চলে এল। তবে প্রাপক তালিকা এবার বিপিএল তালিকাভুক্তদের মধ্যে থেকে নয়, প্রাপকদের তালিকা প্রস্তুত হয়েছে আর্থ-সামাজিক ও জাতিগত জনগণনার খসড়া তালিকায় থাকা নাম থেকে।
আগে ইন্দিরা আবাস যোজনা থাকাকালীন সমতলের উপভোক্তারা পেতেন ৭০ হাজার টাকা। অসমতলের উপভোক্তারা ৭৫ হাজার। দুটি কিস্তিতে টাকা দেওয়া হত। এ বার বাড়ি বানানোর জন্য একজন উপভোক্তা পাবেন ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। অসমতলের জন্য আরও ১০ হাজার টাকা বেশি। অতিরিক্ত ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণের সুবিধা। আগামী ৩ বছরের মধ্যে এককোটি বাড়ি ওই প্রকল্পের মাধ্যমে করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রতিটি বাড়ির মাপ হবে ২০ থেকে ২৫ বর্গ মিটার। একটি পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর সহ। আর এই বসতটুকু নিয়েই হাজার অনিয়মের অভিযোগ।
জেলা প্রশাসনের কর্তারা বলছেন, ইন্দিরা আবাস প্রাপকদের খসড়া তালিকায় নাম রয়েছে জেলার ১৬৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার জন্য কম বেশি ১৮০০-২০০০ জন করে উপভোক্তার। সেই তালিকার মধ্যে কারা আদৌও আবাসান প্রকল্পে আসার যোগ্য তা নিয়ে প্রতিটি গ্রাম সংসদ সভায় আলোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। প্রশ্ন উঠছে আদৌ সভাগুলি হয় কিনা সে নিয়ে!
প্রকল্পে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্লক থেকে মৌজা অনুযায়ী সে তালিকা প্রাকাশিত হয়েছে, সেই তালিকাটি প্রিন্ট বা জেরক্স করে গ্রাম পঞ্চায়েতে অফিসে টাঙিয়ে রাখতে হবে।
প্রতিটি সংসদদের জনপ্রতিনিধিরা তালিকায় নাম থাকা উপভোক্তাদের চিহ্নিত করে দেখবেন তাঁরা ইতিমধ্যেই অন্য কোনও সরকারি অবাসন প্রকল্পে বাড়ি পেয়েছেন কিনা। পেয়ে থাকলে সেই নামগুলিকে চিহ্নিত করবেন। এরপরই আসছে গ্রাম সংসদ সভার গুরুত্ব। কেউ যদি ওই এলাকার বাসিন্দা না হন, সরকারি চাকুরে হন, কিংবা দশহাজার টাকার বেশি মাসিক আয়ের অধিকারী হন তাহলে ওই তালিকা থেকে সেই নামটি বাদ দেওয়া হবে। এ ছাড়াও কারও মাছ ধরার নৌকা, মোটর চালিত কৃষি যন্ত্র বা দু’ চাকা বা চারচাকা গাড়ি থাকলে সভা তাঁদের নামও বাদ দিতে পারে। অন্যদিকে তালিকাভূক্ত ছিলেন না অথচ আর্থ-সামাজিক ও জাতিগত জনগণনার খসড়া তালিকায় নাম রয়েছে এমন কেউ নতুন করে আবেদন করলে তাঁর নাম নথিভুক্ত হবে। জেলা পরিষদের যুগ্ম সচিব কৌশিক সিংহ বলেন, ‘‘প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে উঠে আসা তলিকা ধরে প্রস্তুত হবে চূড়ান্ত তালিকা। এরপর প্রকল্পের জন্য যেভাবে টাকা বরাদ্দ হবে ক্রমিক সংখ্যা অনুযায়ী পরপর আবেদনকারীরা বাড়ি পাবেন।’’ পঞ্চায়েত প্রধানদের একাংশ মনে করছেন, সত্যি সত্যিই যদি গ্রাম সংসদ সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয় এবং মানুষ যদি একটু সচেতন হন তাহলেও বেনিয়মের সুযোগ কম।
তবে অন্য ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন কোনও কোনও প্রধান। তাঁরা বলছেন, অভিজ্ঞাতা থেকে বলতে পারি অধিকাংশ সংসদ সভাই হবে কাগজে কলমে। ফলে চিত্র বদলানোর সুযোগ নেই! দুবরাজপুরের বিডিও বনমালী রায় বলছেন, ‘‘যেন সংসদ সভাগুলি সঠিক ভাবে হয়, সেটা যেমন নজরে রাখা হবে, তেমনই এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে ইতিমধ্যেই প্রচার শুরু হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy