মারধরের পরে রাস্তায় পড়ে রয়েছেন রক্তাক্ত কোরবান শেখ। (ডান দিকে) পুলিশের এই গাড়িটিরই পিছনের কাচ ভেঙে দিয়েছে উন্মত্ত জনতা।—নিজস্ব চিত্র।
চোর সন্দেহে মানসিক ভারসাম্যহীন কোরপানকে এনআরএস-এর জুনিয়র ডাক্তারের থামে বেঁধে গণপিটুনি দিয়ে খুন করেছিলেন বলে অভিযোগ। রামপুরহাটে একই অভিজ্ঞতা হয়েছে দুই বাসযাত্রী মহিলার। তার ঠিক ৪৮ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই এ বার ছেলেধরা সন্দেহে উন্মত্ত জনতা গাছে বেঁধে পিটিয়ে আধমরা করে দিল কোরবান শেখ নামে এক যুবককে। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। উদ্ধার করতে আসা পুলিশের উপরেও চড়াও হল জনতা। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যুবককে ‘জনতার আদালতে’ ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে ভাঙচুর করল পুলিশের গাড়িও!
মঙ্গলবার সকালে নলহাটির পাইকপাড়ার ওই ঘটনায় আরও একবার প্রশ্নের মুখে এলাকাবাসীর মানবিকতা। পরে আরও বাহিনী নিয়ে এসে পুলিশ ওই যুবককে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করে। যুবককে খুনের চেষ্টা এবং পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও জেলার পুলিশ সুপার ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি। তবে, ভারপ্রাপ্ত এসডিপিও (রামপুরহাট) সমর পাণ্ডে জানান, পুলিশ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে। অন্য দিকে, নলহাটি ১ বিডিও তাপস বিশ্বাস বলেন, ‘‘জেলাশাসকের সঙ্গে মিটিংয়ে ব্যস্ত আছি। ঠিক কী ঘটেছে, জানি না। তবে, এমন কিছু ঘটে থাকলে এ ব্যাপারে এলাকার মানুষকে সচেতন করা হবে।’’
সম্প্রতি পড়শি জেলা মুর্শিদাবাদেও ছেলেধরা সন্দেহে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে মারধরের ঘটনা ঘটেছে। জনতার শাসন থেকে এক যুবককে উদ্ধার করতে গিয়ে জলঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছে পুলিশ। কোনও রকমে স্কুলের অফিসে ঢুকে রক্ষা পান স্থানীয় বিডিও। জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানান, রানিনগর, ডোমকল, জলঙ্গির মতো বেশ কিছু এলাকায় ছেলেধরার গুজবে স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা কমে গিয়েছিল। মানসিক ভারসাম্যহীন-সহ বেশ কিছু লোকজন প্রহৃতও হয়েছেন। গুজব রুখতে প্রশাসনের তরফে সচেতন করা হচ্ছে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, পাইকপাড়া পঞ্চায়েতের আশ্রমপাড়া এলাকায় একটি শিশুশিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত ওই এলাকাতেই। এলাকার বাসিন্দা, প্রাক্তন পুলিশ কর্মী দীনেশ ঘোষের দাবি, ‘‘চার শিশুকে এক অপরিচিত যুবক চকোলেট, বিস্কুট খাওয়ানো এবং মোবাইলে গান শোনানোর লোভ দিয়েছিল। শিশুরা ভয় পেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে। তখনই এলাকার কিছু মানুষ ছেলেধরা সন্দেহে ওই যুবককে মারধর শুরু করে।’’ তিনি জানান, প্রথমে পাইকপাড়া বাসস্ট্যান্ড মোড় থেকে আধ কিলোমিটার দূরে ওই যুবককে লোজ জন পেটায়। তার পরে সেখান থেকে যুবককে পাইকপাড়া মোড়ে নিয়ে গিয়ে একটি গাছে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। ততক্ষণে চারিদিকে খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। দীনেশবাবুর দাবি, ‘‘আমি দড়ির বাঁধন খুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু, তত ক্ষণে প্রায় তিন থেকে চারশো লোক ওই যুবককে ঘিরে ফেলেছে। যারাই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তারাই ওই যুবককে ঘিরে ধরে মারতে থাকে।’’ এ ভাবে বর্বরের মতো মেরেও উন্মত্ত জনতা ক্ষান্ত হয়নি। অভিযোগ, এর পরে দড়ির বাঁধন খুলে যুবককে রাস্তায় ফেলে ইট দিয়ে ঠুকে ঠুকে মারা হয়। তার সারা শরীর দিয়ে তখন রক্ত ঝরছে। কিন্তু, কেউ বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। উল্টে খবর পেয়ে যুবককে উদ্ধারে আসা পুলিশকেও ছাড়েনি জনতা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, নলহাটি থানার একজন এএসআই এবং তিন কনস্টেবল ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন। তাঁরা মৃতপ্রায় যুবককে গাড়িতে তোলার চেষ্টাও শুরু করেছিলেন। কিন্তু, উন্মত্ত জনতা যুবককে নিজেদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানাতে থাকে। যুবকের ‘বিচার’ জনতাই করবে সেই ‘আবদার’ও শুরু হয়। অভিযোগ, তখনই পুলিশের গাড়ির পিছন দিকের কাচ ভেঙে ফেলা হয়। প্রাণ বাঁচাতে পুলিশও যুবককে ফেলে চম্পট দেয়। ঘণ্টাখানেক ধরে মারধর চলার পরে শেষমেশ আধমরা ওই যুবককে নলহাটি-মুরারই রাস্তার উপরে ফেলে পালিয়ে যায় জনতা। অনেক পরে পুলিশ এলাকার একটি অ্যাম্বুল্যান্সে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই যুবককে হাসপাতালে পাঠায়।
এ দিন ঘটনার পরে পাইকপাড়া মোড় বাসস্টপে গিয়ে দেখা যায় অন্যান্য দিনের তুলনায় লোকজন প্রায় নেই। কয়েকটি মাত্র দোকান খোলা। অথচ ঘণ্টা দেড়েক আগে এই মোড়েই কোরবানকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দিয়েছে প্রায় তিন থেকে চারশো জনতা। সেখানকার দোকানদার দুখু মাল, মনোজ মাল, ছোটন মালরা জানান, এলাকায় খবর ছড়িয়েছিল, ওই যুবক স্কুলের চারটে ছেলেকে নিয়ে পালাচ্ছিল। সেই জন্যই জনতা রেগে যায়। মনোজবাবু বলেন, ‘‘শ’য়ে শ’য়ে লোক মোড়ে জড়ো হয়ে গিয়েছিল। সেখানে কে কাকে বারণ করবে? বারণ করলে, যে বলছে তাঁকেই মার খেতে হচ্ছিল!’’ তবে, কারা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করেছে, তা তাঁরা দেখেননি বলে দাবি করেছেন।
এ দিকে, গণপ্রহারে জখম হয়ে রামপুরহাট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুপুরে কোরবান শেখ নামে ওই যুবক জানায়, তাঁর বাড়ি মুরারই থানার পাইকর ২ পঞ্চায়েত এলাকার মাঠবসুরি গ্রামে। এলাকায় হোগল শেখ নামে সে বেশি পরিচিত। মাথায় ও মুখে ব্যান্ডেজ অবস্থায় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে জানাল কোরবান বললেন, ‘‘ওদের আমি বললাম, আমাকে ছেলেধরা বলে মনে হলে পুলিশে দাও। এ ভাবে মেরো না। কিন্তু, কেউ শুনল না। বিনা অপরাধে আমাকে নির্মম ভাবে মারল।’’ যুবকের মামাতো ভাই সাহিদুল ইসলাম জানান, বোলপুরে টিউমার অপারেশনের জন্য কোরবান সকালে ইন্টারসিটি ধরাতে স্ত্রীকে মুরারই স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর দাবি, ‘‘ওর স্ত্রী বোলপুরে পৌঁছলেও কোরবান কী করে পাইকরে চলে গেল বুঝতে পারছি না!’’ একটু আধটু নেশা করলেও কোরবানের নামে এলাকায় কোনও খারাপ কাজের সঙ্গে থাকার অভিযোগ নেই বলেই সাহিদুলের দাবি। পাইকপাড়াতে কী করছিল, তার স্পষ্ট দিতে পারেননি কোরবানও। তিনি শুধু বলেন, ‘‘আমি রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলাম। পথে স্কুল ফেরত বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেই জন্য ওরা আমাকে মারল!’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার তো মোবাইলই নেই। তা হলে কী করে গান শোনাব! চকোলেট, বিস্কুটই বা কেন খাওয়াতে যাব!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy