Advertisement
২২ মে ২০২৪
পুলিশ ফাইল থেকে

গাড়ির জন্য খুন, বেচতে গিয়ে জালে

সকালে অল্প একটু খেয়ে ছেলেটা গাড়িতে সওয়ারি নিয়ে বেরিয়েছিল। কোথায় যাচ্ছে বলে যায়নি। রাতে হতেও যখন সে ফিরল না, বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ে যায়।

পুরুলিয়া-বরাকর রাস্তার ধারে এখান থেকেই উদ্ধার হয়েছিল দীপকের দেহ। —ফাইল চিত্র

পুরুলিয়া-বরাকর রাস্তার ধারে এখান থেকেই উদ্ধার হয়েছিল দীপকের দেহ। —ফাইল চিত্র

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৩৯
Share: Save:

সকালে অল্প একটু খেয়ে ছেলেটা গাড়িতে সওয়ারি নিয়ে বেরিয়েছিল। কোথায় যাচ্ছে বলে যায়নি। রাতে হতেও যখন সে ফিরল না, বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ে যায়।

দীপক বাউরি। পিতৃহারা দীপক ছোটবেলা থেকে মামার কাছেই মানুষ। থাকতেন ঝাড়খণ্ডের বোকারো জেলার চন্দকিয়ারি থানার শিববাবুডিতে। গাড়ি চালানো শিখেছিলেন। সদ্য তাঁর মামা প্রাণকৃষ্ণ বাউরি একটা দুধসাদা গাড়ি কিনে দিয়েছিলেন দীপককে। সেটা চালিয়েই নিজের পায়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন যুবকটি।

কিন্তু তারই মুখ থুব়ড়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হয় পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কের ধারে, পুরুলিয়া মফ্সসল থানার ছড়রা গ্রামের কাছের একটি খেত থেকে। দিনটা ৭ জুন, ২০১৫। ওই দিনই দীপক ভাড়া নিয়ে বেরিয়েছিলেন। সারা রাত ফোন সুইচ অফ করে রাখা। প্রাণকৃষ্ণবাবু ভেবেছিলেন, কাজে আটকে গিয়েছে। সকাল হলেই ফিরে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। ৮ জুন বিকেলে তাঁকেই শনাক্ত করতে হয়েছিল রাতভর মর্গে পড়ে থাকা দীপকের দেহ।

তদন্তে নামে পুলিশ। পাড়ায় খোঁজ খবর করে জানা যায়, দীপকের পুরুলিয়ার দিকে যাওয়ার কথা ছিল। ততক্ষণে পাড়া থানার বাগালমারি জলাধারের পাশ থেকে রক্তমাখা জামাকাপড় উদ্ধার হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ, খুনিই সেই জামা ফেলে গিয়েছে। কিন্তু দীপকের সেই গাড়িটা কোথায়? তার মধ্যেই যে রয়ে গিয়েছে অনেক প্রশ্নের উত্তর, তা আঁচ করতে পেরেছে পুলিশ।

এ বারে খবর আসে আদ্রা থেকে। রেল শহরে নাকি কিছু দিন ধরেই ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা দুধসাদা গাড়ি। তাতে কোনও নম্বর প্লেট নেই। সোর্স মারফত পুলিশ খবর পায়, দু’ জন সেই গাড়ি বিক্রি করার চেষ্টায় রয়েছেন। বিবরণ শুনে পুলিশ মোটের উপরে নিশ্চিত হয়, সেটি দীপকের গাড়ি। জাল বিছিয়ে, ১২ জুন আদ্রা-রঘুনাথপুর রাস্তার ধারে একটি কালী মন্দিরের সামনে থেকে গাড়িটি আটক করা হয়। আটক করা হয় দু’জনকেও। পুলিশ জানতে পারে, ধৃতদের মধ্যে এক জন, মানস ঘোষ, দীপকের গ্রাম শিবাবুডি লাগোয়া মাড়রার বাসিন্দা। অন্য জন, মানসের মাসতুতো ভাই পিন্টু ওরফে পরিতোষ বাউরি। আদ্রার ইঞ্জিনিয়ারিং কলোনির বাসিন্দা ওই তরুণ ভোজুডির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ত।

পুলিশের দাবি, টানা জেরায় খুনের কথা স্বীকার করে নেন ধৃতেরা। তাঁদের থেকে উদ্ধার হয় দীপকের মোবাইল ফোন। যে ছুরি দিয়ে দীপককে খুন করা হয়েছিল উদ্ধার হয় সেটিও।

কেন খুন করা হল দীপককে? তদন্তের সঙ্গে জড়িত পুলিশ আধিকারিকদের দাবি, গাড়িটির উপরে বেশ কিছু দিন ধরে নজর ছিল মানসের। ছক কষে, পুরুলিয়া যাওয়ার নাম করে দীপকের গাড়ি ভাড়া করে সে। ৭ জুন দুপুরে দীপকের সঙ্গে রওনা দেয় মানস। পথে, ভোজুডি স্টেশনের সামনে থেকে গাড়িতে ওঠে পিন্টু। পুলিশের দাবি, সাঁওতালডিহিতে একটি দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পিন্টুকে দিয়ে মদ আনান মানস।

কিছু দূর গিয়ে ফের গাড়ি দাঁড় করাতে বলে। দীপককে বলা হয়, মানসের বাবা স্কুটার নিয়ে পুরুলিয়ায় অনুষ্ঠান বাড়িতে এসেছেন। কিন্তু ক্ল্যাচের তার ছিঁড়ে গিয়েছে। তার জন্য একটা তার কিনে নিয়ে যেতে হবে।

পুলিশের দাবি, জেরায় ধৃতেরা স্বীকার করে, তার কিনে গাড়িতে ওঠার পরে পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার একটি ফাঁকা মাঠের কাছে গাড়ি থামিয়ে তিন জন মদ খায়। সেই ফাঁকে খুনের পরিকল্পনা করে ফেলেন মানস ও পিন্টু। দু’জনে প্রথমে গাড়িতে উঠে পড়েন। মানস বসেন পিছনের সিটে। পিন্টু ড্রাইভারের পাশের সিটে।

এক তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকের দাবি, কাপড়ের মধ্যে ক্ল্যাচের তার ভরে ওঁৎ পেতে ছিলেন মানস। দীপক উঠতেই গলায় শক্ত করে ফাঁস দিয়ে দেয় সে। টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়। কিন্তু মানসের একটি পা দুর্বল। শক্তসমর্থ দীপকের সঙ্গে সে এঁটে উঠতে পারছিলেন না। সেই সময় পাশের সিট থেকে পিন্টু ছুরি দিয়ে দীপককে কোপাতে শুরু করে।

খুনের পরে গাড়ি পুরুলিয়া শহরের দিকে ঘুরিয়ে নেন দু’জন। গ্রামের রাস্তা দ্রুত গাড়ি ছুটে যেতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল কারও কারও। কিন্তু অসুস্থ রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছেন বলে দ্রুত এলাকা ছেড়ে বেড়িয়ে যান দু’জন। পুলিশের দাবি, বড় রাস্তায় ওঠার পরে শুঁড়িবাঁধের কাছে দীপকের দেহ ফেলে দেওয়া হয়। তারপরে বাগালমারি গিয়ে রক্তমাখা জামাকাপড় ফেলে জলাধারের জলে গাড়ির ভিতরে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে ফেলা হয়। সেখান থেকে সটান জামশেদপুর।

কিন্তু যে গাড়ির লোভে খুন, সেটি বেচতে গিয়েই দু’জন ধরা পড়ে যায়। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, আদালতে মামলার চার্জশিট জমা পড়েছে। ধৃতেরা আপাতত জামিনে মুক্ত রয়েছেন। পিন্টু নাবালক হওয়ায় তাঁর বিচার হবে জুভেনাইল আদালতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Murder Car selling arrest police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE