Advertisement
০৫ মে ২০২৪

শিল্প কই, ভোটের আগে ফের প্রশ্ন রঘুনাথপুরে

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এখানে শিল্পায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল। জেলা সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারবার শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এই অঞ্চলে। এ রাজ্যের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পরুলিয়ার রঘুনাথপুর কিন্তু থেকে গিয়েছে কার্যত শিল্প-বন্ধ্যাই। হাতের পাঁচ বলতে ডিভিসি-র নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তা-ও বারবার থমকে যাচ্ছে জমি-জটে। পুরভোটের মুখে এই বিষয়টি নিয়ে চোরা অস্বস্তি রয়েই যাচ্ছে শাসক-শিবিরে।

এলাকায় সিপিএমের মিছিল। নেতৃত্বে প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

এলাকায় সিপিএমের মিছিল। নেতৃত্বে প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া। ছবি: প্রদীপ মাহাতো

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০২:০৭
Share: Save:

রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এখানে শিল্পায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তৃণমূল। জেলা সফরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বারবার শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখিয়েছেন এই অঞ্চলে। এ রাজ্যের অত্যন্ত সম্ভাবনাময় পরুলিয়ার রঘুনাথপুর কিন্তু থেকে গিয়েছে কার্যত শিল্প-বন্ধ্যাই। হাতের পাঁচ বলতে ডিভিসি-র নির্মীয়মাণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। তা-ও বারবার থমকে যাচ্ছে জমি-জটে। পুরভোটের মুখে এই বিষয়টি নিয়ে চোরা অস্বস্তি রয়েই যাচ্ছে শাসক-শিবিরে।

শিল্প না হওয়ায় এলাকার মানুষের বড় অংশের ক্ষোভ যদি তৃণমূল নেতৃত্বের চিন্তার বিষয় হয়, তা হলে তাঁদের মাথাব্যথা বাড়িয়েছে লোকসভা ভোট পরবর্তী সময়ে বিজেপি-র উত্থান। রঘুনাথপুরে টানা দশ বছর ধরে পুরসভা পরিচালনা করার পরেও এ বারের লড়াই যে কঠিন, তা ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন এলাকার অনেক তৃণমূল নেতাই। বিশেষ করে বিজেপি যে ভাবে সংগঠন বাড়িয়েছে, তা তাঁদের উদ্বেগের কারণ। রঘুনাথপুর যে তৃণমূলকে ভোগাতে পারে, তার ইঙ্গিতও মিলেছে পরপর দু’টি ভোটে। গত লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে পাঁচটি ওয়ার্ডে পিছনে ফেলে দিয়েছে গেরুয়া শিবির। আরও তাৎপর্য়পূর্ণ, মাস তিনেক আগেই রঘুনাথপুর কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। মাত্র দু’টি আসনের জন্য ছাত্র সংসদ হাতছাড়া হয়েছে প্রথমবার রঘুনাথপুর কলেজে প্রার্থী দেওয়া এই ছাত্র সংগঠনের। ছাত্র সংসদের ৪২টি আসনের মধ্যে ২০টিতে জিতেছে এবিভিপি।

বিজেপি নেতাদের দাবি, কলেজ ভোটের ফলের প্রভাব পুর-নির্বাচনেও পড়ার সম্ভবনা যথেষ্ট। কারণ, কলেজের পড়ুয়াদের একটা বড় অংশ রঘুনাথপুর শহরের বাসিন্দা। তা ছাড়া, শহরের মোট ভোটারদের একটা বড় অংশই তরুণ প্রজন্মের। বিজেপি-র পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লোকসভা ও কলেজ নির্বাচনের পরে এই জেলায় রঘুনাথপুরকে পাখির চোখ করেই লড়তে নেমেছি আমরা। বিশদে রাজনৈতিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। দেখে নেবেন, এ বার পুরভোটে রঘুনাথপুরেও ‘ভাগ মদন ভাগ’ হচ্ছেই!’’ রঘুনাথপুরে তৃণমূলের বিদায়ী পুরপ্রধানের নাম মদন বরাটের উদ্দেশেই বিকাশবাবুর এই কটাক্ষ। প্রতিটি সভাতেই বিজেপি নিয়ম করে তুলে ধরছে তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগকে। এ বার রঘুনাথপুরে বিজেপি-র অন্যতম স্লোগান দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ পুরসভা গঠন। প্রার্থী বাছাই ভোটের প্রথম দিকে নিয়ে দলের অন্দরে কিছুটা গণ্ডগোল তৈরি হলেও শেষ দিকে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠে ঐক্যবদ্ধভাবেই মাঠে নেমে পড়েছে বিজেপি।

টানা দশ বছর পুরসভা পরিচালনা করার ফলে এমনিতেই এ বার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তৃণমূলের। উন্নয়ন না হওয়া-সহ স্থানীয় নানা বিষয় নিয়ে বিরোধীরা প্রচারে তৃণমূলকে ধারবাহিক ভাবে বিঁধছেনও। একই সঙ্গে প্রাধান্য পাচ্ছে রঘুনাথপুরে শিল্পায়ন না হওয়ার প্রসঙ্গ। শিল্পায়ন যে নেহাতই মরীচিকা, তা পরের পর ভোটে ঠেকে শিখেছেন স্থানীয় মানুষ৷ বাম ও তৃণমূল উভয় সরকারই বারবার এখানে শিল্পস্থাপনের নানা ঘোষণা করেছিল৷ কর্মসংস্থানের কথাও ফলাও করে বলা হয়েছিল। এলাকার মানুষের ক্ষোভ, এ সবই আসলে কথার কথা। শহরের এক প্রবীণ বাসিন্দা ক্ষোভের সুরে বললেন, ‘‘রঘুনাথপুরে অন্তত চারটি বৃহত্‍ শিল্প হবে বলে আশা দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ ওই ঘোষণার মধ্যে শুধু ডিভিসি-র তাপবিদ্যুত্ কেন্দ্রের কাজ হচ্ছে৷ কারখানা গড়ার পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছে শ্যাম স্টিল, জয় বালাজির মতো শিল্প গোষ্ঠী৷ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আশা দিয়েছিলেন, এখানে বৃহত্‍ শিল্পতালুক হবে৷ কারখানা গড়বে নানা বেসরকারি সংস্থা। তার পর এত দিন গড়িয়ে গেলেও শিল্প কোথায়?’’

শেষবেলায় ভোটের প্রচারে এসে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কিংবা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমও রঘুনাথপুরে পুরোমাত্রায় সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও শিল্পায়ন না হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে শাসকদলের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন। শিল্পায়ন যে পুরভোটে বিরোধীদের অন্যতম হাতিয়ার হয়েছে, তা বুঝেই তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা তথা মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে রঘুনাথপুরে প্রচারে এসে বলতে হয়েছে, “রঘুনাথপুরে শিল্প স্থাপনে রাজ্য সরকার সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।”

বস্তুত, এ বার রঘুনাথপুরে নির্বাচনী লড়াইটা চর্তুমুখী হতে চলেছে। ভোটের যুদ্ধে মূল রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে রয়েছে শাসকদলের গোঁজ প্রার্থীরাও। স্থানীয় ভাবে জানা যাচ্ছে, তিনটি ওয়ার্ডে লড়াইয়ে রয়েছে এসইউসি। শাসকদলকে ভোগাচ্ছে চারটি ওয়ার্ডে গোঁজ প্রার্থীরাও। এমনকী টিকিট না পেয়ে নির্দল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন তৃণমূলের এক বিদায়ী কাউন্সিলর। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে এক জনকেও প্রার্থী না করার ক্ষোভে নির্দল হয়ে লড়াই করছেন আরএসপি থেকে তৃণমূলে যোগ দেওয়া বিদায়ী কাউন্সিলরের স্বামী তথা তৃণমূল কর্মী। আর এই ভোটকাটাকটির জটিল অঙ্কেই দশ বছর পরে রঘুনাথপুরে ফের বাজিমাত করার বিষয়ে আশাবাদী বামফ্রন্ট। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রচারের শেষ দিন, বৃহস্পতিবার সকালে শহরে বড়মাপের মিছিল করে সাড়া ফেলতে সমর্থ হয়েছে বামেরা। সিপিএম সূত্রের খবর, এ বার ভোটের আগে ঘরোয়া বৈঠক, ছোট ছোট কর্মিসভা, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের সাথে কথা বলার মতো নিরবিচ্ছিন্ন জনসংযোগ গড়ার দিকে নজর দেওয়া হয়েছিল। চেষ্টা করা হয়েছে বসে যাওয়া দলের কর্মীদের ফের সক্রিয় করতে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, রঘুনাথপুরের দায়িত্বে থাকা দীননাথ লোধার দাবি, ‘‘রঘুনাথপুর শহরে বরাবরই আমাদের জনভিত্তি রয়েছে। বিভিন্ন কারণে আমাদের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ অন্য দিকে চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের ফের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আর এটা ভোটে প্রতিফলিত হলেই রঘুনাথপুরে ফল অন্য রকম হবে।’’

বিরোধীদের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে ফের তাঁরাই পুরসভার দখল নিচ্ছেন বলে দাবি করেছেন রঘুনাথপুরে তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি। তিনি বলেন, ‘‘গত দশ বছরে ধারাবাহিক ভাবে উন্নয়ন হয়েছে রঘুনাথপুর শহরে। ফলে আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট তৈরি হওয়ার পরিস্থিতিই হয়নি।” লোকসভা ও কলেজ নির্বাচনের সঙ্গে পুরভোটের বিস্তর ফারাক রয়েছে দাবি করে বিধায়করে বক্তব্য, ‘‘বিজেপি রঘুনাথপুরে কোনও ফ্যাক্টরই নয়! আর বামেদের এখানে দূরবীণ দিয়ে খুঁজতে হয়।’’ দলের গোঁজ প্রার্থীদেরও বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে তিনি নারাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE