Advertisement
E-Paper

নাটক দেখে চোখে জল সাজাপ্রাপ্তদের

 এক আদিবাসী তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ভিন্ জাতের এক যুবকের। সেটা ভাল ভাবে নেননি সমাজের মাথারা। সমাজের ‘সম্মান রক্ষার্থে’ বিষয়টি গড়ায় সালিশি সভায়। প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জনকেই প্রথমে সারারাত গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়।

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:০৫
সিউড়ি সংশোধনাগারে। নিজস্ব চিত্র

সিউড়ি সংশোধনাগারে। নিজস্ব চিত্র

এক আদিবাসী তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ভিন্ জাতের এক যুবকের। সেটা ভাল ভাবে নেননি সমাজের মাথারা। সমাজের ‘সম্মান রক্ষার্থে’ বিষয়টি গড়ায় সালিশি সভায়। প্রেমিক-প্রেমিকা দু’জনকেই প্রথমে সারারাত গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। সেখানে গ্রামের মোড়ল মোটা টাকা জরিমানা হাঁকেন। অনাদায়ে নিদান দেন, ‘টাকা না পেলে মেয়েটিকে ধর্ষণের’। অভিযোগ, সেটাই ঘটেছিল সে দিন। ভাই-বাপ-দাদার বয়সী ওই লোকগুলো অত্যাচার চালিয়েছিল আদিবাসী তরুণীর উপরে।

বছর চারেক আগে লাভপুরের সুবলপুর গ্রামে আদিবাসী তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মতো নাড়িয়ে দিয়েছিল এলাকার নাট্যদল বীরভূম সংস্কৃতি বাহিনীকেও। সেই ঘটনা অবলম্বনে ওই নাট্যদল তৈরি করেছিল নাটক ‘নজর’। নারী নির্যাতনের পাশাপাশি নাটকে তুলে ধরা হয়েছে ডাইনি অপবাদে মহিলাদের উপরে অত্যাচারের দিকটিও। উদ্দেশ্য আদিবাসী সমাজে নারীর অসহায়তা তুলে ধরা। এবং সমাজের চেতনায় আঘাত করা। শুক্রবার প্রজাতন্ত্র দিবসে উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় লিখিত ও নির্দেশিত সেই ‘নজর’ মঞ্চস্থ হল সিউড়ি জেলা সংশোধনাগারে। ৪০৩ জন বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দি একসঙ্গে বসে দেখলেন সেই নাটক।

সিউড়ি জেল সুপারিনটেনডেন্ট আবদুল্লা কামাল বলছেন, ‘‘জেল তো এখন সংশোধনাগার। ক্ষণিকের ভুলে অন্যায়ের পথে পা বাড়ানো অপরাধীদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোই এখন উদ্দেশ্য। সাজাপ্রাপ্ত বিচারাধীন বন্দিদের অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা এমন অপরাধে অভিযুক্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত। অপরাধের স্মৃতি উসকে দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর পথ আরও সুগম করতেই এমন ভাবনা।’’ মহকুমাশাসক (সিউড়ি) কৌশিক সিংহ বলছেন, ‘‘সমাজসংস্কার মূলক নাটক ‘নজর’ বহুবার মঞ্চস্থ হয়েছে বাইরে। কিন্তু জেলের আবাসিকরাও যাতে এটা দেখতে পান, সেটাই চেয়েছিলাম আমরা।’’ ভুল চোখের সামনে নাটকের দৃশ্যপটে তুলে ধরতেই এই পন্থা, জানাচ্ছেন কৌশিকবাবু।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডাইনি’ গল্পের স্বর্ণ চরিত্র এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফুলমনিয়ার মা। নাটকে সাঁওতাল তরুণী ফুলমনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে রহমের। কিন্তু, রহমের সঙ্গে ফুলের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়ায় গ্রামের মোড়ল। ঘটনাচক্রে এই মোড়লই স্বর্ণ ডাইনের মেয়ে ফুলমনিকে গ্রামে ফিরিয়ে এনেছিল শহর থেকে। কিন্তু তাঁকে এড়িয়ে রহমের সঙ্গে সম্পর্কই ফুলমনিয়ার কাল হয়। সালিশি ডেকে ভিন্ জাতের এক যুবকের সঙ্গে সর্ম্পক রাখার ‘অপরাধে’ মোড়ল বিধান দেন, ‘ঘোর বিপদ। গাঁয়ে আবার ডান হইচে। সেই সন্ন ডানের বিটি ফুলমনিয়া।’ বিধান দেন শারীরিক নির্যাতনের! নাটকের ষষ্ঠ দৃশ্যে সেই ভয়াবহ রাতের ঘটনা দেখানো হয়েছে। যা দেখে জেলের আবাসিকদের কেউ ডুকরে কেঁদে ফেললেন। কেউ আবেগ তাড়িত হলেন। আবার কেউ সংকল্প করলেন না, এই পথে আর নয়।

আরও একটি অদ্ভুত সমাপতন। এই মুহূর্তে সুবলপুরের ঘটনায় ১৩ জন দোষী সাব্যস্তদের কয়েক জন এখন সিউড়ি জেলা সংশোধানাগারে। তাদের কী প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে? এই নিয়ে জেল আধিকারিকরা মন্তব্য করেননি। তবে নাটকের কাহিনীতে সামান্য রদবদল হলেও এটা যে তাঁদের জীবনকথা থেকেই তুলে আনা হয়েছে, সেটা কিছু সময়ের মধ্যেই টের পেয়ে যান তাঁরা।

নাট্যকার উজ্জ্বল বলছেন, ‘‘লাভপুরে সে দিন একটি সম্প্রদায়ের ‘সম্মান’ ও ‘রক্ষণশীলতা’ লঙ্ঘনের দায়ে সালিশি সভার নিদানে যে ঘটনা ঘটেছিল সেটা ভয়াবহ। নাটকের মাধ্যমে সেই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’’ নাটক শেষে অনেক আবাসিক এসে তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁরা ভাল হতে চান। কেউ বলেছেন, ‘‘আপানাদের নাটক কাঁদিয়ে দিয়েছে।’’

গত বছর ১৫ অগস্টে লাভপুরের এই সংস্কৃতী বাহিনীই মাদক বিরোধী একটি নাটক করে গিয়েছিলেন সিউড়ি জেলা সংশোধনাগারে। খুব ভাল প্রভাব পড়েছিল তার। অনেক মাদকাসক্ত জেল থেকে বেরিয়ে রি-হ্যাব সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ২৬ জানুয়ারির ‘নজর’ থেকেও তেমন প্রভাব পড়বে আশাবাদী জেল কর্তৃপক্ষ।

Drama Theatre Prison Prisoners
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy