Advertisement
০২ মে ২০২৪
উদ্বেগে চিকিৎসকেরা

রক্তের আকাল, সঙ্কটে রোগী

ব্লাড ব্যাঙ্কে ঢোকার মুখে চেয়ারে বসে চুপটি করে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেবিনা বিবি। কোলে শুয়ে আদুল গায়ে দু’ বছরের নাতি মীরজাহান। দাদির কোলে মাথায় রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ঘুম নেই দাদি সেবিনার। সেই কবে থেকে যে শান্তিতে ঘুমোতে পারেন না তিনি! থেকে থেকেই চোখ চলে যাচ্ছে করিডরে। কেউ কি ডাকল!

রামপুরহাট হাসপাতালে চলছে রক্ত সংগ্রহের কাজ। —নিজস্ব চিত্র

রামপুরহাট হাসপাতালে চলছে রক্ত সংগ্রহের কাজ। —নিজস্ব চিত্র

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়
রামপুরহাট শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৫৪
Share: Save:

ব্লাড ব্যাঙ্কে ঢোকার মুখে চেয়ারে বসে চুপটি করে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন সেবিনা বিবি। কোলে শুয়ে আদুল গায়ে দু’ বছরের নাতি মীরজাহান। দাদির কোলে মাথায় রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। ঘুম নেই দাদি সেবিনার। সেই কবে থেকে যে শান্তিতে ঘুমোতে পারেন না তিনি!

থেকে থেকেই চোখ চলে যাচ্ছে করিডরে। কেউ কি ডাকল!

এই বুঝি ডাক পড়বে রক্তের জন্য— সারাক্ষণ এই ভেবেই যে জেগে আছেন বৃদ্ধা সেবিনা। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত দু’ বছরের নাতির রক্তের জন্যই তো তাঁর এই অপেক্ষা। সেই সকাল ৯টার সময় মাড়গ্রাম থানার কেলাই গ্রাম থেকে জেলা হাসপাতালে এসেছেন।

বেলা গড়িয়ে এখন দুপুর বারোটা। রক্তের অপেক্ষায় বসে আছেন তিনি। সঙ্গে মিরজাহানের মা বাতিসা বিবি ও দিদি, ছ’ বছরের নাসরিন খাতুন। নাসরিনও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। রক্তের প্রয়োজন তারও। কিন্তু রক্ত আর মেলে কোথায়!

ফি বছর গরম পড়তে রক্তের আকাল যেন চেনা সমস্যা হয়ে পড়েছে জেলা হাসপাতালগুলিতে। রক্তের জন্য পাশের জেলা থেকেও রোগীদের এসে ফিরে যেতে হচ্ছে। বিপদে পড়ছেন অনেকেই। রক্তাল্পতা নিয়ে ভর্তি থাকা মুর্শিদাবাদের ঝিল্লি -খাসপুর এলাকার তনুজা বেওয়া, শাবলদহ গ্রামের নাহেলা বেওয়া যেমন। দু’জনেরই দু’ বোতল করে রক্তের প্রয়োজন। ব্লাড ব্যাঙ্কে তাঁরা কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। কিন্ত রক্ত মজুত না থাকার জন্য তাঁদের রক্তদাতা জোগাড় করে আনতে হচ্ছে। বাতিসা বিবির বক্তব্য, ‘‘মেয়ে ও ছেলে দু’জনেরই প্রতি মাসে দু’ বার রক্তের প্রয়োজন হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে একবার রক্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আবারও দরকার পড়েছে। কিন্তু হাসপাতালে রক্ত বাড়ন্ত। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে জানিয়েছে রক্তদাতা আসলেই রক্ত পাবো। তাই অপেক্ষা করছি! জানি না কতদিন এই অপেক্ষা করতে হবে!”

স্বাস্থ্য জেলার হাসপাতালে কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?

হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের মেডিক্যাল অফিসার প্রশান্ত সানা বলেন, ‘‘ছুটিতে আছি। আমার পরিবর্তে চিকিৎসক অরূণলাল মণ্ডল চার্জে আছেন।’’ কিন্তু চেষ্টা করেও অরুণবাবুকে ফোনে পাওয়া গেল না। হাসপাতালের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ‘রক্ত শূন্য’ অবস্থা কোনওদিন বলা হয় না। কারণ রোড ট্র্যাফিক অ্যাকসিডেন্টের জন্য প্রতিটি গ্রুপের চারটি করে ইউনিট তাঁদেরকে বাফার স্টক হিসাবে রক্ত রাখতে হয়। এখন সেই বাফার স্টকেও তাঁদেরকে হাত দিতে হয়েছে। সেই স্টকে প্রতিটি গ্রুপের দুটি করে ইউনিট রয়েছে বলে জানান ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা।

জেলা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে দিন দশেক থেকে এই রক্তের আকাল চলছে। রক্ত পেতে গেলে ওই গ্রুপেরই একজন দাতার রক্ত তাঁদের দিতে হবে। ভোটের মাঝে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে রক্তদান শিবির করা যাবে না বলে নির্দেশ আছে। সেই জন্য শিবির থেকেও রক্তের যোগানও বন্ধ। গত ১৪ মার্চ মল্লারপুর টুরকু হাঁসদা লপসা হেমব্রম কলেজ থেকে রক্তদান শিবির থেকে ৫৪ জনের রক্ত সংগ্রহ হয়েছিল। তারপর থেকে আর ক্যাম্পই হয়নি! হাসপাতালের এক কর্মীর দেওয়া তথ্যে, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০ ইউনিট রক্তের চাহিদা রয়েছে। ২৩৭ জন থ্যালাসেমিয়া রোগী আছেন, তাঁদের কেউ প্রতি সপ্তাহে, কেউ বা সপ্তাহে দু’বার, কেউ বা মাসে দু’বার রক্ত নিতে আসে হাসপাতালে। পরিস্থিতি এমনই, রক্তের যোগান নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্মীরা।

এমন সমস্যা দূর করতে গত চার দিন থেকে ব্লাড ব্যাঙ্কে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রামপুরহাট এলাকার কয়েকজন যুবক। ওয়াসিম আলি ভিক্টর, সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়, আকাশ আলি, ইন্দ্রজিৎ প্রামাণিক, অপূর্ব মজুমদার নামে ওই সব স্থানীয় যুবকরা রক্ত দিয়ে সাহায্য করছেন। অনেক সময় রক্তদাতা যোগাড়ও করে দিচ্ছেন। কিন্তু চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। এখনই বিকল্প কোনও পথ না ভাবলে সমস্যা আরও বাড়বে বলছেন চিকিৎসকরা।

রামপুরহাট স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ব্রজেশ্বর মজুমদার বলেন, ‘‘রক্তের জোগানের অভাবে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন বিধি নিষেধ থাকার জন্য ক্লাব থেকে রক্ত দান শিবির করা যাচ্ছে না। কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যদি ইচ্ছা করে তাহলে রক্তদান শিবির করতে পারে। এই সঙ্কটের দিনে কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যদি এগিয়ে এলে ভালো হয়।” মহকুমাশাসক সুপ্রিয় দাস বলেন, ‘‘নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে রক্তদান শিবিরে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যদি আয়োজন করে তাহলে অবশ্যই অনুমোদন দেওয়া হবে। খুব দ্রুত শিবিরের আয়োজন করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rampurhat crisis Shortages blood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE