Advertisement
১৭ মে ২০২৪

বর্ষাতি পেঁয়াজে লাভ, শিবির জেলায়

পেঁয়াজ কাটার আগে কিনতে গিয়ে দাম শুনেই গৃহস্থের চোখের জল বেরোনোর উপক্রম। এ বছরটাই নয়, গত কয়েকবছর ধরে এমনই হচ্ছে। তাই রাজ্য সরকার পেঁয়াজ চাষে স্বাবলম্বী হতে চাইছে।

স্লাইড-শোয়ের মাধ্যমে পেঁয়াজচাষের প্রশিক্ষণ রঘুনাথপুরে। —নিজস্ব চিত্র।

স্লাইড-শোয়ের মাধ্যমে পেঁয়াজচাষের প্রশিক্ষণ রঘুনাথপুরে। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
পুরুলিয়া ও রঘুনাথপুর শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৫ ০২:৩৩
Share: Save:

পেঁয়াজ কাটার আগে কিনতে গিয়ে দাম শুনেই গৃহস্থের চোখের জল বেরোনোর উপক্রম। এ বছরটাই নয়, গত কয়েকবছর ধরে এমনই হচ্ছে। তাই রাজ্য সরকার পেঁয়াজ চাষে স্বাবলম্বী হতে চাইছে।

কোথাও কৃষি দফতরের সাহায্যে বনদফতর, কোথাও বা উদ্যানপালন দফতর চাষিদের পেঁয়াজ চাষের সুলুক সন্ধান দিতে নেমে পড়েছেন। এ বার তাই বর্ষায় চাষিদের ধান চাষের সঙ্গে বর্ষাতি পেঁয়াজ চাষের জন্য পুরুলিয়া জেলাজুড়ে বিভিন্ন জায়গায় কৃষি বিশেষজ্ঞরা কর্মশালা করছেন।

বলরামপুরের এমনই এক শিবিরে বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তপনকুমার মাইতি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যে সাধারণত শীতকালে পেঁয়াজ চাষ করা হয়। কিন্তু মার্চ মাসে যখন সেই পেঁয়াজ ওঠে, তখন বাজারে জোগান বেশি থাকায় দাম ভাল মেলে না। তখন গরম পড়ে যাওয়ায় ওই পেঁয়াজও বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। কিন্তু বর্ষায় জোগান কমতেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। পুজোর সময় পেঁয়াজের দাম তুঙ্গে উঠে যায়। তাই চাষিরা যদি ধানের সঙ্গে কিছু জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেন, তাহলে তাঁরা বিকল্প এই চাষের মাধ্যমে লাভের মুখ দেখবেন।’’ আর সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই বনদফতর বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষে উদ্যোগী হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুরুলিয়ার ডিএফও ওমপ্রকাশ।

তপনবাবুর অভিজ্ঞতা, পরীক্ষামূলক ভাবে তাঁরা নদিয়া, মেদিনীপুরের পরে বাঁকুড়াতেও বর্ষাকালে পেঁয়াজের চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। তাঁরা আশা, পুরুলিয়ার মাটিতেও পেঁয়াজ হবে। কারণ এখানে বৃষ্টি হলেও, মাটিতে জল জমে থাকে না। জেলা ভূমি সংরক্ষণ বিভাগের সহ-অধিকর্তা আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুরুলিয়ায় পেঁয়াজ চাষের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। অম্ল মাটিতে পেঁয়াজ ভাল হয়। পুরুলিয়ার মাটিও অম্ল। বর্ষার তাপমাত্রাও এই চাষের উপযুক্ত।’’

আর এই জেলার মাটি যে বর্ষায় পেঁয়াজ চাষের উপযোগী তা হাতে কলমে দেখেছেন রঘুনাথপুর মহকুমার বেশ কিছু চাষি। সম্প্রতি রঘুনাথপুরে মহকুমাশাসকের দফতরে রঘুনাথপুর ১, ২ এবং নিতুড়িয়া, সাঁতুড়ি ব্লকের ৩৫ জন চাষিকে নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির করল জেলা উদ্যানপালন দফতর।

বর্ষাকালে পেঁয়াজ চাষের পদ্ধতি-সহ ফসল থেকে বীজ তৈরির বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তাঁদের। উপস্থিত ছিলেন মহকুমাশাসক সুরেন্দ্রকুমার মীনা, জেলা উদ্যানপালন দফতরের আধিকারিক সামন্ত লায়েক, দফতরের রঘুনাথপুর মহকুমা আধিকারিক তামসী কোলে-সহ প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা।

গত দু’বছর ধরে রঘুনাথপুর মহকুমায় পেঁয়াজ চাষে চাষিদের উৎসাহ দিয়ে আসছে উদ্যানপালন দফতর। তার ফলও মিলেছে। মহকুমার ছ’টি ব্লকের দুই শতাধিক চাষি ইতিমধ্যেই ১২০-১৩০ বিঘা জমিতে বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ শুরু করেছেন। পেঁয়াজ চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন ওই চাষিরা। যেমন সাঁতুড়ির মধুবনপুর গ্রামের শান্তিরাম মাজি, রঘুনাথপুর১ ব্লকের শাঁকা গ্রামের শ্যামল পট্টনায়েক। ওই শিবিরে শান্তিরামবাবু বলেন, ‘‘ধানচাষের পাশাপাশি উদ্যানপালন দফতর থেকে বীজ নিয়ে এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষ করেছিলাম। চার মাসে লাভ হয়েছে ২৩ হাজার টাকা।” আর শ্যামলবাবুর ক্ষেত্রে লাভের অঙ্ক প্রায় ২০ হাজার টাকা। দু’জনেই বলেন, ‘‘পেঁয়াজের বরাবর ভাল বাজার রয়েছে। তাই ঠিক ভাবে চাষ করতে পারলে লাভবান হবেন চাষিরা।”

বলরামপুরের শিবিরে কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানালেন, মাটি তৈরিতে মূলত বিঘা প্রতি তিন টন গোবর দিতে হবে। পেঁয়াজের মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশের প্রয়োজন। মাটি হবে ঝুরঝুরে। বীজতলা হবে সমতল। এক সপ্তাহ বয়সের চারা বসাতে হবে। এন- ৫৩ বা বসন্ত- ৭৮০ প্রজাতির যে সমস্ত বীজ মেলে তাতে এখানে ভাল পেঁয়াজ হতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এক বিঘাতে তিন হাজার কেজি পর্যন্ত পেঁয়াজ হতে পারে। তপনবাবু জানাচ্ছেন, তবে টানা বৃষ্টি হলে তখন গোবর সার ব্যবহার করা যাবে না। বদলে পাতা পচা বা ভার্মিকম্পোস্ট দিতে পারেন। ফসফরাস বা পটাশও ব্যবহার করা যেতে পারে। তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে পেঁয়াজ উঠে আসবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, খড়ের ছাউনি ও বাঁশের চাটি দিয়ে ঘিরে পেঁয়াজ অনেকদিন পর্যন্ত মজুত করা যায়। অন্য সব্জির মতো সহজে পচে যায় না। বিঘা প্রতি পেঁয়াজে ১২-১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত মিলতে পারে। তবে চাষ করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, বীজতলা যেন একটু উঁচু জায়গা হয়, যাতে জল না জমতে পারে। জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এখানে প্রচুর টাঁড় এবং উঁচু জমি রয়েছে। ফলে পেঁয়াজ চাষ নিয়ে আমরা আশাবাদী হতেই পারি।’’

ডিএফও ওমপ্রকাশ বলেন, ‘‘আমরা এ বছর বলরামপুর ও ঝালদা ২ ব্লকে ১১৫ বিঘা জমিতে বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ করছি। চাষিদের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। চাষের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে।’’

উদ্যানপালন দফতরের আধিকারিক তামসী কোলে জানান, কেজি প্রতি পেঁয়াজ বীজের দাম ১৭৫০ টাকা। রঘুনাথপুরের শিবিরে তাই কী ভাবে বীজ তৈরি করতে হয় সেটাই হাতেকলমে শেখানো হয়েছে শিবিরে। উৎপাদিত পেঁয়াজের কিছুটা চাষিরা বীজ তৈরি করে রাখলে শীতকালে ও পরের বছর বর্ষাকালে আর বীজ কিনতে হবে না। দফতরের পরামর্শ, পেঁয়াজের ধসা রোগ আটকাতে ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করে চারা তৈরি করুন চাষিরা।

তামসীদেবী বলেন, ‘‘চাষিরা পেঁয়াজের বীজ নিজেরা করতে পারলে তাঁদের লাভও অনেকটা বেড়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE