লড়াই। প্রয়োজনীয় লোকবল ও সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করতে হচ্ছে জেলার দমকল কর্মীদের। —ফাইল চিত্র
মোট কেন্দ্র রয়েছে তিনটি। ইঞ্জিন সাকুল্যে সাতটি। দীর্ঘ দিন ধরে শূন্য পাঁচ সাব-ইনস্পেক্টরের পদ। একই ভাবে নিয়োগ হয়নি সাতটি ফায়ার ইঞ্জিন অপারেটর কাম ড্রাইভারের পদও। আর এই ঢাল-তরোয়াল দিয়েই সামলাতে হচ্ছে জেলার ৪,৫৪৫ বর্গকিলোমিটার। গত পাঁচ বছর ধরে তৃণমূল সরকারের উন্নয়নের ঢক্কা নিনাদের মধ্যে এ ভাবেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বীরভূমের জরুরি পরিষেবা— দমকল। এমন বেহাল পরিকাঠামোর মাসুল গুনতে হচ্ছে জেলার সাধারণ মানুষকেই। রাজ্যের নজর না থাকলেও এমন করুণ পরিকাঠামো নিয়েই সাধ্যমতো লড়ে যাচ্ছেন জেলার দমকম কর্মীরা।
দিন কয়েক আগের কথা। জেলার দুই প্রান্তে প্রায় একই সময়ে আগুন লেগেছিল। একটি ক্ষেত্রে দমকল যখন যখন পৌঁছয়, তার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে ৩০টি বসত বাড়ি। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে খবর দেওয়া হলেও পৌঁছতেই পারেনি দমকলের কোনও ইঞ্জিন। সেখানে ভস্মীভূত হয় পাঁচটি বাড়ি। প্রশ্ন উঠতে পারে, দমকলের গাফিলতিতেই কি বাঁচানো গেল না বাড়িগুলিকে? দমকল বিভাগের দাবি, আসল সমস্যা অন্যত্র। সমস্যা মূলত পরিকাঠামোর। জেলার মোট তিনটি দমকল কেন্দ্র রয়েছে তিন মহকুমা সদর সিউড়ি, বোলপুর ও রামপুরহাটে। সিউড়িতে তিনটি, রামপুরহাট ও বোলপুরে দু’টি করে মোটে সাতটি ইঞ্জিন রয়েছে জেলা দমকলের দখলে। আর তার উপর ভরসা করতে হচ্ছে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে অগ্নিকাণ্ডের ও ক্ষয়ক্ষতির ভবিষ্যতের। দমকলে বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। শুধুমাত্র সিউড়ি মহকুমার হিসাব ধরলে, ফেব্রুয়ারি মাসে ২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মার্চে ৩৩টি। এ ছাড়া শুধু আগুন নেভানোর কাজেই নয়, বিশেষ ‘রেসকিউ অপারেশন’ও দমকল বাহিনী চালিয়ে থাকে। গত দু’মাসে এমন ১৭টি ‘স্পেশ্যাল জব’ সিউড়ি দমকলকে করতে হয়েছে। আরও একটি বিষয়, যেহেতু প্রায় বছরই এই সময় (যখন অগ্নি সংযোগের ঘটনা সব চেয়ে বেশি ঘটে) কোনও না কোনও নির্বাচন থাকে। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা হেলিকপ্টারে সভাস্থলে আসেন। তার জন্য দমকলের ইঞ্জিনগুলিকে বরাদ্দ রাখতে হয়। এ বারও থাকতে হয়েছে। সেই সময় কোথাও আগুন লাগলে কারও কিছু করার থাকবে না বলেই মত কর্মীদের।
শুধু অপর্যাপ্ত ইঞ্জিনই নয়, সঙ্গে রয়েছে কর্মীর অভাবও। তিনটি দমকল কেন্দ্রে পাঁচ সাব-ইনস্পেক্টরের পদ শূন্য। ফায়ার ইঞ্জিন অপারেটর কাম ড্রাইভারের সাতটি পদ খালি। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া ডিভিশনের তুলনায় (সেখানে ফায়ার ইঞ্জিন অপারেটর কাম ড্রাইভারের পদ খালি ৪০টি) চিত্রটা কিছুটা ভদ্রস্ত হলেও তা-ও যে পর্যাপ্ত নয়, স্বীকার করে নিয়েছেন বাঁকুড়া–পুরুলিয়া ডিভিশনের বিভাগীয় কর্তা অশোক ভট্টাচার্য। বীরভূমের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা অশোকবাবু বলেন, ‘‘পরিকাঠামোগত সমস্যা আছেই। তবুও তা নিয়েই সাধ্যমতো চেষ্টা করে দমকলবাহিনী। কিন্তু, দমকল কেন্দ্র থেকে যদি ৫০-৬০ কিলোমিটার দূরে কোথাও খড়ের বাড়িতে বা পালুইয়ে আগুন লাগে, সেখানে দমকলের ইঞ্জিন পৌঁছে সত্যিই কি কিছু করতে পারবে?’’ আরও একটি সমস্যা জলের। তাঁর কথায়, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, আগুন নেভাতে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, সেই জলের জোগান কোথায়? অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুকুর বা জলাশয় শুকিয়ে গিয়েছে। কেন সেখানে জল নেই, সে প্রশ্নের জবাব আমার দেওয়ার কথা নয়। কিন্তু ঢাল-তলোয়ার ছাড়া কি যুদ্ধ সম্ভব?’’
দমকলের কর্মীরা জানাচ্ছেন, দফতরের হাতে থাকা বর্তামন ইঞ্জিনগুলিতে মেরেকেটে ২-৩ হাজার লিটার জল থাকে। এক সঙ্গে গোটা কয়েক বাড়ি বা খড়ের পালুইয়ে আগুন লেগে গেলে ওই সামান্য জল দিয়ে আগুন নেভানো সম্ভব নয়। এ তো গেল গ্রাম অঞ্চলের কথা, শহরের ছবিটাও কিছুমাত্র আলাদা নয়। জলের জোগানের অবস্থা আরও করুণ। সমস্যা বাড়িয়েছে ঘিঞ্জি এলাকা, বহুতল বাড়ি এবং দখলদারি। যে কারণে দমকলের ইঞ্জিন সময়মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছতে পারে না। বহুতল বাড়ি নিয়ে অশোকবাবুর বক্তব্য, ‘‘অধিকাংশ বাড়ি নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী একটি বহুতল বাড়িতে দু’টি সিঁড়ি থাকবে। কোনও বহুতলে একবার আগুন লাগলে নীচে নামার পথ যদি ‘স্মোক-লক’ হয়ে যায়, বহু মানুষ মারা পড়বেন। যাঁদের সেটা দেখার কথা, সেটা তাঁরা দেখেন না। অথচ অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেলে খুব সহজেই দমকল বাহিনীর উপর দোষারোপ করা হয়।’’
বহুতল নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে সত্যি সত্যিই তেমন কড়াকড়ি করা হয় না, আড়ালে স্বীকার করে নিয়েছেন জেলার বেশ কয়েক জন পুরপ্রধানও। সিউড়ির পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায় এবং দুবরাজপুরের পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে, দু’জনেই বলছেন, ‘‘বহুতল নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে ঠিকই। তবে আমরা চেষ্টা করি যাতে নিয়ম মানা হয়।’’ আর দখলদারি? এ ব্যাপারে অবশ্য কথা খরচ করেননি পুরপ্রধানেরা। দমকল বিভাগের কর্তারা জানাচ্ছেন, পরিকাঠামোর সমস্যা বাদ দিলে আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে দু’টি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক, জলের অভাব। দুই, সচেতনতার অভাব। গ্রীষ্মের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে অধিকাংশ জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছে। সমস্যা মেটাতে বিডিও এবং পুরপ্রধানদের চিঠি দেয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড জলাধার কোথায় করা সম্ভব, তার একটি রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যা নিয়ে বিভাগের এক কর্তার মতামত, ‘‘সচেতনতার অভাবেই অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। টিনের বাড়িতে আগুন লাগার প্রবণতা কম। কিন্তু সকলের সামর্থ্য নেই তাঁদের বাড়িগুলিতে টিনের ছাউনি দেবেন। যাঁদের খড়ের বাড়ি রয়েছে, তাঁরা যদি আগুন ব্যবহারের পরে সঠিক ভাবে নিভিয়ে দেন, সেই ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি জররি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy