Advertisement
০৩ মে ২০২৪

সেই স্মৃতি তাড়া করলেও চান না সহানুভূতির ভোট

রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে ছিল দেহটা। মাথায়, বুকে, গলায় ক্ষত। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি রক্তে ভিজে লাল। মায়ের আঁচল ধরে বাবার মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি।

ভোটের প্রচারে রাজীব সোরেন। —নিজস্ব চিত্র

ভোটের প্রচারে রাজীব সোরেন। —নিজস্ব চিত্র

সমীর দত্ত
বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬ ০৩:০৫
Share: Save:

রাস্তার ওপর আড়াআড়ি ভাবে পড়ে ছিল দেহটা। মাথায়, বুকে, গলায় ক্ষত। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি রক্তে ভিজে লাল। মায়ের আঁচল ধরে বাবার মৃতদেহের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ছোট্ট ছেলেটি। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারিয়েছিল সে দিনের ছোট্ট রাজীব। সে দিনের শিশুটি এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে বান্দোয়ান কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। রাজীব সোরেন।

১৯৮৪ সালের ২০ মে পাঁড়রা গ্রামে খুন হন পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক, স্থানীয় কংগ্রেস নেতা জাগরণ সোরেন। তখনও বোরো থানা হয়নি। গ্রামটি মানবাজার থানার অধীনে ছিল। জাগরণবাবুকে খুন করার অভিযোগ উঠেছিল সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। রাজীব জানান, বাবার মৃত্যুর দৃশ্যটা এখনও তা়ড়া করে বেড়ায় তাঁকে। তবে নির্বাচনী প্রচারে সেই প্রসঙ্গ টেনে আনতে চান না তিনি। বাবাকে হারানোর বেদনা রাজনীতির কারবারের থেকে আলাদা করে রাখতে চান। জানান, সেই বেদনা তাঁর ব্যক্তিগত।

তবে রাজনৈতিক হত্যা হিসাবে যে ঘটনা জেলার মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে, তাকে রাজনীতির থেকে আলাদা করে রাখা মুশকিল। রাজীব বলেন, ‘‘প্রতিটি কর্মিসভায় বা প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নমূলক কাজের কথা তুলে ধরি। তবে প্রায়ই দলের কর্মীরা জানতে চান বাবার কথা। তাঁদের অনুরোধ ফেলা যায় না।’’ এখনও পর্যন্ত জেলা থেকে প্রচার সূচি আসেনি। ফলে, নিজের মতো করেই প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন রাজীব। তাঁর স্ত্রী প্রতিমাদেবী নিজেও জেলা পরিষদের সদস্য। স্নান সেরে সকাল আটটার মধ্যে বান্দোয়ানের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন স্বামী-স্ত্রী। গাড়িতে চষে বেড়ান বান্দোয়ান, বোরো এবং বরাবাজারের বিভিন্ন এলাকা। দলীয় নেতা কর্মীরাই নতুন প্রার্থীকে চিনিয়ে দেন এলাকা। রাজীব জানান, তিনি আপাতত জোর দিচ্ছেন কর্মীদের সঙ্গে পরিচয় করা এবং এলাকায় মিছিলের উপরে।

বান্দোয়ানের চিরুডি হাইস্কুলের শিক্ষক রাজীব সোরেন মাস দুয়েক দেখা করতে গিয়েছিলেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। রাজীব বলেন, ‘‘সেই সময় দিদির সঙ্গে একান্তে মিনিট পাঁচেক কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। তিনিও বাবার নৃশংস হত্যার কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন।’’ রবিবা ররাজীব যান বরাবাজারের বেড়াদা অঞ্চলে। কিছুকাল আগেও ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া বেড়াদা এলাকা মাওবাদী নাশকতার অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। সেখানেও উঠে আসে চুরাশি সালের সেই ঘটনার প্রসঙ্গ।

প্রতিমাদেবী জানান, বিয়ে হয়ে এই পরিবারে আসার পর শাশুড়ির কাছে তিনি শুনেছিলেন সেই কষ্টের দিনগুলির কথা। তিনি বলেন, ‘‘শ্বশুরমশাই খুন হওয়ার পরে পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন আমার শাশুড়ি। দু’বেলা ডাল ভাতের সংস্থানটুকুও নিশ্চিত ছিল না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন খাওয়া পরার চিন্তা নেই, কিন্তু ওই এক দিনে যে শূন্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছে তা কোনও দিনই পূরণ হওয়ার নয়।’’

বান্দোয়ান বিধানসভায় রাজীবের নির্বাচনী লড়াই পোড় খাওয়া বিধায়ক সিপিএমের সুশান্ত বেসরার সঙ্গে। রাজীবের মতো সুশান্তবাবুও পেশায় শিক্ষক। রাজনীতিতে নতুন মুখ রাজীবের পক্ষে এই লড়াই যে সহজ নয় তা মনে করছেন অনেকেই। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বান্দোয়ান কেন্দ্রে কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট প্রার্থী ছিলেন কংগ্রেসের শীতল হেমব্রম। পরিবর্তনের সেই জোয়ারের মধ্যেও বান্দোয়ানে দুর্গ রক্ষা করতে পেরেছিল বামেরা। সিপিএমের সুশান্ত বেসরা সে বার ২২ হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন শীতলবাবুকে। তবে লোকসভা নির্বাচনে সেই অঙ্কটা পাল্টে যায়। ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের অধীন বান্দোয়ান বিধানসভায় তৃনমূল প্রার্থী উমা সরেন প্রায় ২২ হাজার ভোটেই পরাজিত করেন সিপিএম প্রার্থীকে।

যদিও লোকসভা ভোটের ফলাফলকে আপাতত গুরুত্ব দিতে চান না বান্দোয়ান বিধানসভার দায়িত্বে থাকা সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য কৃষ্ণপ্রসাদ সিংহ দেও। তিনি বলেন, ‘‘বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনের চরিত্র আলাদা। সাংগঠনিক ক্ষমতার জোরে আমরা বান্দোয়ান বিধানসভা ধরে রাখব এ বারও।’’ এক দিকে যখন সাংগঠনিক ভিত্তির উপর জোর দিচ্ছেন বামেরা, তৃণমূল প্রার্থীর ভরসা নেত্রীর নাম। রাজীব বলেন, ‘‘সহানুভূতির ভোট আমি চাই না। মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়ন মূলক কাজই আমার হাতিয়ার।’’ তবে প্রায় প্রতিটি প্রচার সভায় তাকে ঘিরে একটা আলাদা আবেগ তৈরি হয়েছে তা উপলব্ধি করতে পারছেন বলে রাজীব জানান। সেই কারণেই বাবার প্রসঙ্গ এলে এড়িয়ে যাচ্ছেন না তিনি। নিজের ব্যক্তিগত বেদনা ভাগ করে নিচ্ছেন দলের কর্মীদের সঙ্গে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

vote electiob assembly election 2016
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE